বনলতা সেন
---- জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূরে অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
ভালোবাসার শপথ
---- ফারজানা সুলতানা
সূর্য তখন বিদায়ের প্রহর গুণছে,
বাতাসে শীতের আনাগোনা;
রিক্ত প্রকৃতির মাঝে বসে আছি আমরা দু’জন-
ভালোবাসার ঐশ্বর্য্যে পূর্ণ হয়ে।
শব্দহীন পৃথিবীর ইন্দ্রজ ছিঁড়ে শুধালাম-
‘চুপ করে কেনো ? কিছু বলছো না যে !
আজ কি তোমার মন ভালো নেই ?”
ভাবনার সমুদ্রে অবগাহন শেষে অনিন্দ্য বলে উঠল
(দীঘশ্বাস ছেড়ে) “ঠিক তা নয়; যখন অতীতটাকে ফিরে দেখি,
যখন চষে বেড়াই বর্তমানের বিস্তীর্ণ-জমিন
তখন নিজেকে কেমন একা একা লাগে !
কিংবা ধর, যখন ভবিষ্যতের সাদা ক্যানভাসে
চেষ্টা করি স্বপ্ন আঁকবার তখন বারবার স্বপ্নটা কেবল
ঝাপসা হয়ে যায়, শুধুই বিবর্ণ হয়ে যায়!
: কেনো নিঃসঙ্গ ভাবো নিজেকে ?
আমি আছি, আমার ভালোবাসা আছে-
এ সত্যটা কি তোমাকে ভরসা দিতে পারে না?
: সেখানেই তো ভাবনাগুলো গভীরে চলে যায়-
কিংবা হোঁচট খায়।
মাঝে মাঝে ভালোবাসার অস্তিত্ব অনুভব করি প্রকট ভাবে
আবার কখনো সেই ভালোবাসাকেই মনে হয় মরীচিকা !
: কিসের এত দ্বিধা তোমার, কিসের সংশয় !
কেনো এই অনর্থক ভাবনা ?
এই যে ঘাস ফড়িংয়ের মত নিরন্তর ছুটে চলেছি
বাড়িয়ে দিয়েছি মমত্বের হাত, বিছিয়ে রেখেছি সোহাগের আঁচল-
এও কি তোমাকে আশ্বস্ত করতে পারে না !
আমার ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ, অনিন্দ্য ?
: চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে-
সত্যি কি ভালোবাসো আমাকে- শুধুই আমাকে ?
আমার ভালোবাসা কি তোমাকে পূর্ণতা দেয় ?
ভরসা দেয় নিঃসঙ্গতায় ?
সূর্যের মতো আলো দেয়Ñযখন পথ হারাও সাদা কুয়াশায় !
: সারাদিন কাটে আমার কার ভাবনায় ?
কার প্রেমে কার ভালোবাসায় আমি মগ্ন হয়ে থাকি !
একাকী মুহূর্তে বুকে হাত রেখে অনুভব করি কার হৃদস্পন্দন?
আমার নিঃসঙ্গতায় কার ছায়া সঙ্গ দেয় সারাক্ষণ !
সাদা কুয়াশায় পথ হারানো আমি খুজি কার হাত-
কার স্পর্শে অপূর্ণ এই আমি পূর্ণ হয়ে উঠি.....
প্রিয় অনিন্দ্য আমার, তুমি কি বোঝো এই আমাকে-
আমার সারা দেহে, প্রাণে সারাক্ষণ খুঁজে ফিরি
তোমাকে, শুধুই তোমাকে।
: ভাবতে বড় ভালো লাগে,
স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। ভালো লাগে
প্রজাপতির ডানায় ভর করে ভেসে বেড়াতে-
তোমার ভালোবাসাকে সঙ্গী করে।
সত্যি যদি তাই হয় তবে আমাতেই মগ্ন হয়ে থাকো-
পূর্ণ প্রানে, বিশ্বাসে, ভালোবাসায়।
কিন্তু কখনও যদি এ ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায়
তাহলে ভেবে নেব পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কিছু নেই
কিছু ছিলো না কোনোকালেই আর
থাকবেও না কোনোদিন !
: আর অনিন্দ্য;
এসো, সব দ্বিধা ভুলে আবার আমরা
ডুবে যাই গভীর ভালোবাসায়;
আবার স্বপ্ন দেখি নতুন করে ঘর বাঁধবার
ভরা জোছনা রাতে, যে রাতে আমরা ভেসে যাবো
উচ্ছাস ও আবেগে সীমাহীন জোয়ারে।
প্রেম, ফিরে এসো
---- অসীম তরফদার
: টেলিফোনের তার বেয়ে
ওপার হতে ভেসে এলো তোমার কন্ঠস্বর;
আমার স্নায়ু, শিরায় চঞ্চল হরিণীর ছুটাছুটি,
হৃদয়ের নীপবনে ময়ূরীর উন্মাতাল নাচন;
যেন এরকম মূহুর্তের জন্য
উন্মুখ হয়ে আছি কতদিন.. কতযুগ.. কতটি বছর…
: সত্যি আমার কথা এখনও ভাবো তুমি?
: জীবিকার টানে আর
সমাজজীবনে একটুখানি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
কিংবা উল্টো স্রোতে টালমাটাল লড়ে
বাঁচার মত বেঁচে থাকার আশায়
সতত কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত থাকা আর
অথৈ জলে হাবুডুবু খাওয়া -
এর মাঝে কারও কথা ভাবার অবসরই হয় না,
এমনকি নিজেকে নিয়েও নয়;
এভাবে অহর্নিশ প্রতিকূল সময়ের সাথে লড়াই করে
এক সময় ভেতরে ভেতরে আমি মরে যাই,
ঠিক তখনই কোন না কোন ভাবে তুমি সামনে চলে আসো
আর জাগিয়ে দাও আমায়, আমার তখন পুনর্জন্ম হয়;
তখন আমি বুঝতে পারি -
আমারও একটা সোনালি অতীত আছে;
একদা আমার মনে প্রেম ছিল, আনন্দ ছিল
কষ্ট ছিল, স্বপ্ন ছিল এবং তুমি ছিলে।
: কেন তোমার এই নিরন্তর সময়ের স্রোতে
নুড়ি পাথরের মত ক্ষয়ে যাওয়া?
সে কি কেবলই অর্থ-বিত্ত আর প্রতিপত্তির নেশা?
: ঠিক নেশা নয়, তবে প্রয়োজন।
জন্মেছি বিত্তহীন বাবার সংসারে
আজন্ম ছিল তাঁর অর্থের অভাব আর আদর্শের স্বপ্ন;
দারিদ্র্যের সাথে আমৃত্যু লড়াই করে আমার চোখের সামনে
তিনি মারা যান বিনা-চিকিৎসায়, পথ্যবিহীন;
বুক ভরা ভালোবাসা, এমনকি
সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও তোমাকে হারালাম
শুধু দারিদ্র্যে, বিত্তহীনতায়।
আর সে থেকেই জানলাম, (জানিনে কতটা সঠিক)
জীবনে আদর্শ অপেক্ষা বিত্তের প্রয়োজন বেশি,
বিত্তহীন আদর্শ নিয়ে মিথ্যে অহমিকা চলে
কিন্তু জীবন চলে না।
: কত বেশি সম্পদ হলে মানুষ বিত্তশালী হয়
অথবা নিজেকে সুখি মনে করে?
ঠিক আছে, তোমার নিজের কথাই বলো -
আর কতটা হলে থামবে তোমার
বিত্ত-বাসনায় এই চোখ-বাঁধা দৌড়?
সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিহীনতায় বৈভবের স্বপ্ন দেখা?
: বৈভবের স্বপ্ন দেখি না কখনও।
সমাজে একটুখানি সম্মান নিয়ে চলা
কিংবা একটু ভালোভাবে বাঁচা, পেট পুরে খাওয়া,
আর এজন্য ন্যূনতম যতটুকু প্রয়োজন
ততটুকু পেতেই আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে,
প্রাচুর্যের স্বপ্ন দেখার অবকাশ কোথায়?
থাক, বাদ দাও ওসব কথা,
ছেড়েছি জীবনের হাল, যাক না যেদিকে খুশি;
এবার অন্য কথা বলো।
: প্রতিদিনের স্বাভাবিক ব্যস্ততায় বয়ে চলে নিরন্তর সময়,
কখনও প্রচন্ড খরতাপ, কখনও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
কখনও আবার বিরামহীন বর্ষণ;
বর্ষার উন্মাতাল প্রকৃতির মতই খেয়ালিপনায়
কেটে যায় আমার দিন-রাত।
তুমি বিত্তের পেছনে ছোটো দারিদ্র্য ঘোচাতে
আর আমি প্রাচুর্যের বৃত্তে-বন্দিনী
খুঁজি একটুখানি সুখ, মমতা খুঁজি
আর বিত্তহীন তোমার ভালোবাসা-
নিজের পায়ের ঘোলা করা জলে।
লক্ষীটি, তুমি আবার হাল ধর শক্ত করে,
আবার তুমি কলম নাও হাতে
দেখো, একদিন সৃষ্টির মাঝেই পাবে সুখ
ঘুচবে তোমার দারিদ্র্য, অর্জিত হবে খ্যাতি;
দেখবে সৃষ্টিতেই সুখ, বিত্তের চেয়ে;
লক্ষীটি, বলো, আবার তুমি লিখবে।
: তোমার ইচ্ছের কাছে বারবার আমি পরাজিত হই।
কিন্তু নৈসর্গের কাছে শব্দ ও ছন্দের প্রার্থনা করে
বড্ড নিরাশ হই আজকাল।
বিশ্বাস কর, ইদানিং আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে লিখতে বসি
অথচ কাক্সিক্ষত শব্দেরা তবু অধরাই থেকে যায়,
বুঝি ব্যর্থ হই আমি।
তবু না হয় আবার চেষ্টা করব
বীজ বুনব অনুর্বর শুষ্ক জমিতে
আবার ফলাব ফসল বিরাণ মাঠে
তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য।
বিসর্জন
---- অসীম তরফদার
পশ্চিমের ঘাট ধরে সূর্যটা ডুবেছে অনেক আগেই
পাখিরাও ঝাঁক ধরে ফিরে গেছে নীড়ে
নদীর ধারে যারা এসেছিল তারাও ফিরে গেছে একে একে।
সন্ধ্যা নামার আগেই চলে গেছে নিপা,
একদা যাকে আমি ভালোবেসে হৃদয়মন্দিরে আসীন করেছিলাম
আরাধনা করেছিলাম আজন্ম তার ভালোবাসায় আপ্লুত হব বলে,
গোধূলির ধূসর আলোয় আমার সেই স্বপ্নচারিণী দেবীর
বিসর্জন হল আজ, এই নদীতীরে, মাত্র কয়েক মূহুর্ত আগে।
এমনই এক গোধূলি লগনে
নিপা একটি লাল গোলাপ দিয়ে বলেছিল -
“এটা গোলাপ নয় – এ আমার হৃৎপিণ্ড, আমার জীবন!
আজ থেকে ওটা তোমার কাছেই বন্ধক রাখলাম।”
হেমন্তের শেষ বিকেলের হলুদ বাদামী আলো এসে পড়েছিল
তার চোখে-মুখে, মনে হল চোখ দুটো ঝর্ণার জলের মত স্বচ্ছ,
সে চোখের গভীরে সেদিন আমার ভালোবাসা খুঁজেছিলাম
আর পরম তৃপ্তিতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে
চুম্বন এঁকেছিলাম কপালে।
একবার একটা কাজে নিপাদের দক্ষিণের ঘরে থাকতে হয়েছিল
কয়েকটা দিন, সে ঘর থেকে নিপার ঘরটি দেখা যায়-
সুযোগ পেলেই জানালা দিয়ে চোখের ইশারায়
কত কথা বলেছি তার কোন হিসেবই নেই।
নিপা খুব বেশি সুন্দরী ছিল না কিন্তু সাজতে ভালোবাসতো,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতো সুন্দর করে
আর আমি অব্যক্ত মুগ্ধতায় তাকে দেখতাম শুধু।
ফাইনাল পরীক্ষার আগে নিপা শেষরাতে উঠে পড়ত
যদিও ছাত্রী হিসেবে বিশেষ সুবিধের ছিল না সে,
পড়া শেষ করে ভোর বেলায় একদিন
দক্ষিণের ঘরের জানালায় এসে জাগালো আমায়;
আর কেউ জাগেনি তখনও
নিপা আমাকে নিয়ে গেল তার শেফালী গাছের নীচে।
পূবের আকাশ কিছুটা লাল হয়েছে সবে, বাতাসে হালকা কুয়াশা
শেফালী পাতা বেয়ে দু’এক ফোঁটা শিশির ঝরছে মাথায়
পড়ছে কিছু শেফালী ফুলও ঝরে
নিপা কয়েকটি ফুল তুলে নিল হাতে,
আমার হাতটি নিয়ে রাখল তার হাতের উপর
ভোরের সে আলোয় নিপাকে দেখাচ্ছিল ভীষণ শুভ্র ও স্নিগ্ধ।
সে তার কোমল হাতে আমার হাতখানি নিয়ে খেলায় মেতে রইল
কিছুটা সময়, তারপর চোখ তুলে তাকালো আমার চোখে;
“তোমার এ হাতখানি আমি ছাড়ব না কিছুতেই
সারাজীবন পাশে থাকব, যত বাধাই আসুক, দেখো;
তুমি আমায় ভূলে যাবে না তো? ছেড়ে যাবে না তো কোনদিন?
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না একদিনও।”
আমরা মোহাবিষ্ট হই এক মধুর স্বপ্ন ও কল্পনায়।
কবিতা ভালোবাসতো নিপা,
প্রায়ই আমার কবিতা নিয়ে পড়ত সে
কবিতা গুলো জীবন্ত হতো তার কন্ঠে, উৎসাহ পেত প্রশংসায়।
বর্ষার এক বিকেলে সে বলেছিল -
“আজ তোমায় সাথে করে নিয়ে যাব প্রেমনগরে
আসল নাম নয় এটি, তবে যুগলেরা এ নামেই চেনে জায়গাটাকে!
শুনেছি সেখানে নদীর কুলে কাশবনে সাদা সাদা ফুলগুলো
দোল খায় দখিনা বাতাসে, গাংচিল বেড়ায় উড়ে
নদীর জলে আপন মনে ভেসে যায় হংসসারি,
সেখান থেকে দেখা যায় দূরে মাঝনদীর চর;
যুগলেরা সেখানে প্লাবিত হয় ভালোবাসায়
আজ আমরাও আবিষ্ট হব, তোমাকে দেব আমার প্রথম চুম্বন।”
সেদিন আমার মনে আনন্দের বান ডেকেছিল
বুকের মধ্যে ঝিলিক দিয়েছিল আশা-আপ্লুত স্বপ্নেরা;
হঠাৎ অঝোর বর্ষণ সেই স্বপ্নকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল
প্রেমনগরে যাবার বদলে আমরা ভিজতে ভিজতে
ফিরে এলাম ঘরে।
আমাকে ভালোবাসে জেনে একদিন ওর মা বকেছিল খুব
সেদিন আমার কাছে এসে অনেক কেঁদেছিল নিপা,
কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিল-
“যে যা খুশী বলুক, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচব না;
যতদিন বাঁচব ততদিন শুধু তোমারই হয়ে থাকব
তুমি শুধু এমনি করেই ভালোবেসো আমায়।”
আমাদের ভালোবাসার স্বপ্নীল উঠোনে তখন
নেচে বেড়াত ফিঙ্গে, শ্যামা, বুলবুলি, কাকাতোয়া;
আমাদের আকাশে উড়ত রং-বেরংয়ের ঘুড়ি
হেমন্ত দিনের মত মেঘমুক্ত সে আকাশে কেবলই
খেলা করত সোনালী রোদ্দুর।
হঠাৎ একদিন সেই নির্মল আকাশ ছেয়ে গেল কাল মেঘে;
আমাদের আপনজনেরা, যারা নিজেদের দাবি করেন
আমাদের মঙ্গলাকাক্সক্ষী বলে, তারা
আমাদের মনের চাওয়াকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে
দুজনার মাঝখানে গড়ে দিলেন দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর।
আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম,
আমার কানে আর ঝংকার তুলে না তার সহাস্য কথামালা
নীলখামে আর আসে না তার চিঠি
গেঁথে দেয় না শিউলী মালা নি:সীম মমতায়।
আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না,
নিপা আর এলো না, হয়ত আসার চেষ্টাও করল না।
তারপর…
পেশাগত কাজে আমি নির্বাসিত হই।
হঠাৎ ক’দিন আগে খবর পেলাম-
নিপা ডেকেছে আমায়, খুব জরুরী।
কিছুটা উৎফুল্ল ও খানিকটা ব্যাকুল চিত্তে ছুটে এলাম আমি;
হয়ত সেখানে জেগেছে এক নতুন সম্ভাবনা
আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন এক পথ,
যে পথ একদা বিলীন হয়েছিল চার বছর আগে।
বুকের মাঝে অসীম আশার ডালি সাজিয়ে
প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গুনে যখন এলাম নিপার কাছে
তখন তাকে মনে হল ঝরা পাতা, বিমর্ষ
ও বৈরী বাতাসের মত অস্থির,
শ্বেত গোলাপের পাপড়ি গুলো অকারণে ছিঁড়তে লাগল
আর সেদিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে বলল-
“কি করে যে তোমায় বলি?
আসলে খুব বড় একটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছি আমি
তুমি চেন তাকে, শোভন, আমার ভালোবাসার জন্য
যে সব সময় কাঙালের মত ঘুরত।
তোমার সাথে যখন বন্ধ হয়ে গেল সব যোগাযোগ
তখন কি করে যেন জড়িয়ে গেলাম আমি,
ভীষণ ভালোবাসে আমায় এবং আমিও তাকে;
তাইতো মুক্তি নিতে এসেছি আজ।
তোমার জন্যেও বড্ড মায়া হয় আমার, তোমায় ঠকিয়েছি আমি
ক্ষমা করে দিও আর আমাদের আশীর্বাদ করো।”
নিপা শুধু একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে
সে চোখের তারায় আমি আবার আমার ভালোবাসা খুঁজলাম
সেখানে তার আর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
ফেলে যাওয়া শ্বেত গোলাপটি পড়ে রইল পথের ধুলায়
অনাদরে, অবহেলায়।
তোমার কাছে আমার একটা পাওনা রয়ে গেল
তোমার সাথে প্রেমনগরে যাওয়া হল না আর,
আজ হল জলাঞ্জলী আমার সকল সুপ্ত আকাক্সক্ষার।
নিপা, এখনও কি তুমি পড়তে বস শেষরাতে উঠে?
তোমার শেফালী গাছে এখনও কি ফুল ফোটে
নাকি ফোটে না আর?
শিশির কি ঝড়ে পড়ে না এখন শীতের প্রভাতে?
তুমি কি করে পারলে, নিপা !
শোভনলাল কেমন অনায়াসে আমার বুক থেকে
তোমায় কেড়ে নিয়ে গেল,
আমি বড় একা হয়ে গেলাম
পৃথিবীতে আপন বলে ভাবার মত কেউ রইল না আর
আমার স্বপ্নের সাজানো বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল
আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
তবুও নিপা, তোমাদের জন্য আমার আশীর্বাদ।
প্রেম এসেছিল নীরবে
---- অসীম তরফদার
কাজের ব্যস্ততায় ডুবে থেকে থেকে
আজ আমি বড় ক্লান্ত।
তাই কোন কাজ নয় আজ; ছুটি নিয়েছি
অফিস, সংসার এমনকি পরিচিত গণ্ডি থেকেও।
বেড়িয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে,
কিছুটা সময় এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা
তারপর চলে এলাম ধানমন্ডি লেকের ধারে,
পাশেই একটা কারুপণ্য প্রদর্শনী, ঢুকে গেলাম কিছু না ভেবেই।
নক্শী করা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ চোখে পড়ল,
কাছে গিয়ে ধরতে গেলাম ব্যাগটি
ঠিক সেই মূহূর্তেই অন্য একটি হাত এসে ধরে ফেলে সেটি
আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ
মনে হল, এ হাতখানি যেন আমার অনেক দিনের চেনা।
তখনও ঘোর কাটেনি আমার, অপলক তাকিয়ে আছি
সেই হাতের দিকে ।
ঘোর কাটল এক সুরেলা কন্ঠের মধুর ঝংকারে-
“আরে আপনি! কেমন আছেন? কতদিন পর দেখা?”
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি দীপান্বিতা!
কোন কিছু বলার সুযোগ দিল না, সঙ্গে করে নিয়ে গেল ডিঙিতে।
দুপুরের প্রখর রোদ, ঝিরিঝিরি বাতাস, লেকের জলে মৃদু কম্পন
আর ডিঙিতে পাশাপাশি বসেছি আমরা দু’জন।
আজ এগার বছর পর দেখা-
কতটা বদলে গেছে দীপান্বিতা এখন
সেদিনের চাপা স্বভাবের মেয়েটি আজ বড় সাবলীল।
“আপনার বৌ নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী?
ভীষণ ভালোবাসে বুঝি আপনাকে?
কোন মেয়ে কি আপনাকে ভালো না বেসে পারে!
আপনার রূপের আর গুণের প্রশংসায় সব সময় ব্যস্ত থাকত
আমার চেনা জানা মেয়েরা
আর আমি হিংসায় ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরতাম-
কেন সবাই এমন করে শুধু নজর দেয়
আমার পছন্দের মানুষটির দিকে!
কি ছেলে মানুষি ভাবনা! ”
শব্দ করে হেসে ওঠে দীপান্বিতা -
“মনে হলে ভীষণ লজ্জা হয় এখন
তবে আপনি যে কেমন মুডি ছিলেন না -
ভালোলাগার কথা বলাতো দূরের কথা বোঝাতেও সাহস করিনি।
কেবলই মনে মনে স্বপ্ন এঁকে গেছি
আর মন্দিরে দেবতার সামনে বসে
আপনার জন্য প্রার্থনা করেছি দিনের পর দিন,
সদয় হলেন না ঈশ্বর! পোড়া কপাল আমার!”
দীপান্বিতা তখন বর্তমানে নেই, চলে গেছে অন্য জগতে
কয়েকটি মূহুর্তের জন্য আমিও ভুলে গেছি, কারও স্বামী আমি
কিংবা দীপান্বিতা অন্য এক পুরুষের স্ত্রী,
হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছি দীপান্বিতার হাত।
শুধু একটি বারের জন্য সাহসী হতে পারলে না, দীপান্বিতা?
শুধু একবার বোঝাতে পারলে না কোন ইশারায়
অথবা আমার চোখ দেখে বুঝতে পারলে না
যে কথাটি আমি বলতে পারিনি হাজার বার চেষ্টা করেও?
ব্যক্তিত্বের খোলস ভেঙ্গে প্রকাশ করতে পারিনি
আমি যে তোমায় ভালোবাসি দীপান্বিতা!
“সত্যি নির্দয় নন বিধাতা, তিনি শুনেছেন আমার প্রার্থনা-
পাইনি হয়ত পার্থিব জগতে তোমায়
তবু বুকের মধ্যে লালন করছি যে তোমাকে
সেই তোমার বুকের মাঝেও আমার জন্য অবারিত ভালোবাসা-
এটাই আমার পরম প্রাপ্তি, এতেই আমার সুখ।
এই যে ভালোবেসে আজ তুমি হাতটি ধরেছো আমার
এই ছোঁয়াটুকু থেকে যাবে সারাজীবন।”
দীপান্বিতার চোখ থেকে ঝরে পড়ে মুক্তোদানা
আমার মুখেও কিছু আসে না বলার মত,
এক ঝাঁক কাল মেঘ যেন ছেয়ে দিল আকাশ
ঢেকে দিল মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল সূর্যকিরণ।
এক বিকেলে রুদ্র ও নন্দিতা
---- অসীম তরফদার
: আজ তোমার কি হল রুদ্র-
এমন উদাস আর মন মরা হয়ে আছো যে!
বাসায় একগাদা মিথ্যে বলে, দু:সহ যানজট ঠেলে
এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে ছুটে এলাম;
সামনে বহমান নদী,
ঢেউয়ের জলে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম কিরণ
নদীর বুক চিরে দূর হতে ছুটে আসা শীতল হাওয়ার পরশ;
কোথায় দুটো রোমান্টিক কথা বলবে তা নয়
তুমি শুধু…
: ভেবেই যাচ্ছি, কি করে তোমার রূপের বর্ণনা করা যায়
আর তোমার পাশে কেমন বেমানান মনে হয় আমাকে!
: ফাজলামো হচ্ছে, না?
তোমাকে বেমানান নয়, মাঝে মধ্যে বরং নিজেকেই
অসম মনে হয় তোমার সামনে।
সত্যি আজ তোমার কত খ্যাতি চারিদিকে,
পেশা মর্যাদা আর ব্যক্তিত্বের দিক থেকে
তুমি ছাপিয়ে যাও আমায়।
তুমি হয়তো সর্বোত্তম নও তবে সুপুরুষ,
হয়তো বিত্ত বৈভবের দিক থেকে অতটা বড় নও তুমি
কিন্তু তোমার হৃদয়টা ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র-
যেখানে সারাজীবন আমি সাঁতার কেটে গেলেও
ছুঁতে পারব না তার শেষ সীমানা।
: নন্দিতা, এটা কিন্তু তোমার বাড়িয়ে বলা অথবা
তোমার মহত্ত্ব আর উদার চিত্তের কারণেই
এমন ভাবে ভাবো তুমি; আর পেশা খ্যাতি মর্যাদা -
এতো তোমারই প্রেরণার ফসল।
গ্রামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার
শরীরে আজও কাদামাটির গন্ধ;
জীবন ও জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে এসেছি শহরে,
কর্মচঞ্চল অথচ প্রাণহীন এই নগরীর
অলি-গলি-রাজপথে একে একে হোঁচট খেয়ে
বাস্তবতার তীব্র কষাঘাতে আমি যখন
অনেকটাই হতাশ এবং বিধ্বস্ত প্রায়
তখনই তুমি এলে কাণ্ডারী হয়ে!
হতাশার অন্ধকারে জ্বেলে দিলে প্রেরণার মশাল
বেদনা-সিক্ত হৃদয়ে দিলে মমতার শীতল পরশ
দিলে নতুন করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দীক্ষা
এক আহত যোদ্ধাকে।
শুধু তোমারই শক্তিতে ভর করে আমি
দাঁড়িয়েছি আবার মেরুদণ্ড সোজা করে,
ক্লান্তিহীন হেঁটে গেছি গন্তব্যের দিকে অবিরাম।
তোমার সান্নিধ্য আর ভালোবাসা না পেলে
হয়ত আর আমার দাঁড়ানোই হত না কোনদিন।
: না, রুদ্র, তুমি তোমার নিজের যোগ্যতা দিয়েই
দাঁড়িয়েছো, আজ তোমার যা কিছু অর্জন, যা কিছু প্রাপ্তি
তার সবটাই তোমার প্রাপ্য ছিল।
আমাদের প্রথম দেখার মূহুর্তে
তোমার বুদ্ধি দীপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি
ঠিক বুঝেছিলাম, তুমি জয় করবার ক্ষমতা রাখো অজেয়কে।
তাই নিশ্চিত নির্ভরতায় আমি তুলে দিয়েছি তোমার হাতে
আমার সমস্ত ভালো-মন্দের ভার
আমার স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা, আমার ভবিষ্যৎ।
হৃদয় নিংড়ে সবটুকু মমতা আর ভালোবাসা
শুধু তোমাকেই দিয়েছি উজাড় করে;
এখনও যা কিছু আছে, আছে যেটুকু সঞ্চয়
তার সর্বস্ব তোমাকে সঁপে দিয়ে
তোমার বুকেই সাজাব ভালোবাসার পালঙ্ক আমার।
: আমায় তুমি ধন্য করেছো নন্দিতা,
প্রথম যেদিন তোমার স্নেহসিক্ত হাত দুটো
আমার মাথায় বুলিয়েছিলে, সেই দিন সেই মূহুর্তেই
তার বিনিময়ে আমি তোমার কাছে সমর্পিত করেছি
আমার হৃৎপিণ্ড এবং নিজেকে।
এসো নন্দিতা, হাত রাখো এ হাতে
আমার চোখের তারায় তোমার দৃষ্টি কর স্থির
চলো, নদীতে ভাসাই ভেলা
নরম হাওয়ায় পাল তুলে দিয়ে, মেলে দিয়ে ডানা
চলো, চলে যাই তেপান্তরের স্বপ্নলোকের দেশে
কাশফুলে ঘর সাজাই মধুর ভালোবেসে।
প্রেমে মাখামাখি
---- অসীম তরফদার
তুমি আমার সকাল বন্ধু
দুপুর সন্ধ্যা রাতি
আমার প্রাণের প্রাণ যে তুমি
আঁধার ঘরের বাতি।
গোলাপ রাঙা অধর তোমার
মিষ্টি মধুর হাসি
সাথী হয়ে সারাজীবন
থেকো পাশাপাশি।
বন্ধু তুমি জোস্না রাতে
পূর্ণ চাঁদের হাসি
নিথর জলে ঢেউ জাগিয়ে
স্বপ্নে বাজাও বাঁশি।
মন বাগানে বন্ধু তুমি
গোলাপ হয়ে ফুটো
হৃদয় জুড়ে গন্ধ ছড়াও
স্বপ্ন মুঠোমুঠো।
বন্ধু তুমি শ্রাবণ দিনের
প্রথম কদম ফুল
মৌসুমী ঐ হাওয়ায় ওড়ে
তোমার এলো চুল।
একটুখানি দেখার আশায়
পথ চেয়ে থাকি
নানা অজুহাতে তুমি
দাও যে শুধু ফাঁকি।
আমার কথা মনে হলে
জানলা খুলে দিও
আমায় দেখার ইচ্ছে হলে
চাঁদকে দেখে নিও
নীলাকাশের চাঁদনী হয়ে
তোমার ঘরে এসে
জোসনালোকে ভরিয়ে দেবো
মধুর ভালোবেসে।
জীবন স্রোতে ছুটে যখন
ক্লান্ত হয়ে পরি
তোমার একটু সোহাগ পেতে
মাথা কুটে মরি।
সময় পেলে বন্ধু তুমি
ফুল বাগানে এসো
একটু খানি পাশে বসে
আমায় ভালোবেসো।
ক্লান্ত হলে বন্ধু তুমি
বারান্দাতে এসো
বেতের মোড়ায় চক্ষু বুজে
উদাস মনে বোসো।
দখিন হাওয়ায় মিশে তখন
আসবো আমি ছুটে
সোহাগ মাখা পরশ দেবো-
ক্লান্তি যাবে টুটে।
রোজ বিকেলে ফুল বাগানে
যদিও না আসি
হৃদয় দিয়ে বন্ধু আমি
তোমায় ভালোবাসি।
এমন করে সাধ মেটে না
ভরে না এ মন
তুমি ছাড়া শূণ্য এ ঘর
অসাড় এ জীবন।
ফাগুন মাসের পূর্ণিমাতে
ফুলের বাসর গড়ে
সাত পাকেতে বেঁধে তোমায়
নেবো আপন করে।
দুঃখ সুখে পাশাপাশি
থাকবো জীবন ভর
ভালোবেসে আমরা দুজন
বাঁধবো সুখের ঘর।
সে ঘর হবে মায়ায় ভরা
প্রেমে মাখামাখি
হিয়ার সাথে বাঁধবো হিয়া
আঁখির ফাঁদে আঁখি।
বন্ধু তুমি থাকলে পাশে
কিসের আবার দুখ
তুমি-ই বন্ধু প্রাণ ভ্রমরা
আমার স্বর্গসুখ।
তুমি আমার সকাল বন্ধু
দুপুর সন্ধ্যা রাতি
আমার প্রাণের প্রাণ যে তুমি
আঁধার ঘরের বাতি।
ভালোবাসায় ভিজব আজ
---- অসীম তরফদার
ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারিনি আজও;
দূর থেকেই দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জনা।
কাছে যেতেই গম্ভীর মুখে বলে উঠল-
“বলতে পার, সাড়ে চার বছরে কত বার
দেখা হয়েছে আমাদের ?
মাত্র তের বার আর প্রতিবারই দেরী করেছো তুমি।
কে জানে, হয়ত আমার সাথে দেখা করতেই
ভালো লাগে না তোমার,
যদি তাই হয় তবে খুশি হতে পার-
মা-বাবা পাত্র খুঁজছেন, হয়ত খুব শীঘ্রই…
কি? তুমি খুশি হয়েছো তো?”
খুশি হবো নাকি দুঃখ পাবো- ঠিক বুঝে ওঠার আগেই
বলে ফেললাম, খুশি হবো না! হাজার হোক বন্ধুর বিয়ে তো।
“শুধুই বন্ধু ! আর কিছু নয়?
আমাদের দেখা না হয় হয়েছে খুবই কম কিন্তু
টেলিফোনের কল্যাণে এতটাই বেশি কথা হয়েছে
যা একজন মানুষকে বোঝার জন্য যথেষ্ট নয় কি?
যদি তুমি কপট না হয়ে থাক
তবে আমি ঠিকই বুঝেছি তোমায়, তুমিও কি বোঝনি আমাকে?
গত বছর আমার জন্মদিনে আমাদের ঘরের ছাদে
অসাবধানে ছুটতে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগেছিল আমার
তুমি ভেবেছিলে আমি জ্ঞান হারিয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস কর
তোমাকে ঘাবড়ে দেবার জন্য আমি শুধু
জ্ঞান হারাবার ভান করেছিলাম।
আর সামান্য ঐ সময়টুকুতে তোমার চোখে মুখে
যে উৎকন্ঠা আর ব্যাকুলতা দেখেছি
‘তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না’ -
যে আকুতি শুনেছি সে কি ভালোবাসা নয়?”
আমি তর্জনী দিয়ে রঞ্জনার ঠোঁট চেপে ধরে বলি-
কেন সুধাও আবার, বুঝেছো যখন সবই!
যতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের প্রেমিক হওয়া যায়
ততটাই ভালোবেসেছি তোমাকে আমি; কিন্তু
যতটা সাহসী হলে সাগর পাড়ি দেয়া যায়
সাহসী হইনি ততটা ঠিক।
বুকের মাঝখানে, যেখানে হৃদয় থাকে সেই খানে যতটা
তীব্র করে তোমাকে বেসেছি ভালো
ততটা স্পষ্ট করে মুখ ফুটে বলতে পারিনি কখনও,
ভয় ছিল, পাছে যদি তোমার বন্ধুত্বও হারাই।
রঞ্জনা এবার নরম গলায় মিষ্টি করে বলে-
“যতবার তুমি দেরীতে এসেছো ততবারই আমি
করেছি তোমায় নিঃশর্ত ক্ষমা,
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে বিলম্ব হলে
থাকে না উপায় কোন সময়কে ফেরাবার।
এত ভালোবাসা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে
শুধু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে করতে যদি আবারও দেরী-
তোমার রঞ্জনা হয়তো চলে যেতো অন্য কারো ঘরে
একাকী তোমাকে ভেবে চোখের জলে ভেজাতো বুক;
তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া
তোমারও কি থাকত কিছু করবার?”
রঞ্জনার হাতখানি ধরে চুম্বন করি আমি,
দিগ্বিজয়ী বীরের মত আকাশে-বাতাসে কম্পন তুলে বলি-
আজ আর বিলম্ব নয় কোন
পাখিরা, তোমরা গেয়ে ওঠো সব, ফুলেরা ছড়াও সুবাস
প্র্রজাপতিরা নেচে ওঠো আমাদের চারিদিকে
আকাশ তুমি বৃষ্টি দাও, আমার রঞ্জনাকে নিয়ে
আজ আমি ভিজব ভালোবাসায়।
কোন বাঁধনে জড়ালে
---- অসীম তরফদার
: শেষ দেখা কবে হয়েছিল মনে নেই, কবে শেষ কথা;
ভালোইতো ছিলাম ভুলে
কেন এতদিন পর ডেকে আনলে হঠাৎ!
: সত্যি করে বলতো-
মনে মনে তুমি প্রত্যাশা করনি- আমি আসি?
আমি কিন্তু আশায় ছিলাম...
: কতবার আমিও ভেবেছি,
পথ চলতে গিয়ে এত জনের সাথে দেখা হয়
নন্দিতার সাথে দেখা হতে পারে না একবার?
এত মানুষের মুখ দেখি
নন্দিতার মুখখানি যদি দেখতে পেতাম!
কিন্তু যতবার ভেবেছি ততবারই পড়েছি দ্বিধায়
নিজের প্রতিচ্ছবিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের সামনে-
যদি অপছন্দ কর অথবা বিব্রত হও,
যদি ভুলে যেতে চাও আমাকে ঘিরে পুরানো অধ্যায়!
: সম্ভব হলেতো বেঁচেই যেতাম;
মাঝে মাঝে ভাবি-
ঈশ্বর যদি মিলিয়েই না দিলেন
কেন যে দিলেন না ভুলে যাবার শক্তি !
যদি আলাদাই করে দিলেন
কেন মনের ভিতর জিইয়ে রাখলেন
এত প্রেম, এত মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা!
জানি, যা কিছু হবার ছিল
অপরিণত বয়সের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে হয়নি যা কিছু-
সবই মেনে নিয়েছো সহজে; তাই
আমার কষ্টের বোঝা আরও অনেক গুন বেশি।
: হাত খানি একবার দেবে? একটু ধরে থাকি...
: সব সময় এত ফরমাল কেন, বলতো?
সেই ছেলেমানুষী মনটা আজও বেঁচে আছে;
না হয় একটু পাগলামীই করলাম!
একি! তোমার হাত কি কাঁপছে!
নাকি আমার হাত!
: সম্ভবত দুজনেরই।
এত বছর পরে দেখা,
একটু খানি স্পর্শ পেয়ে, এতটুকু উষ্ণতা পেয়ে
বহু বছরের সঞ্চিত কথাগুলো
দিশেহারা হয়ে বেরুতে চাইছে।
বিধাতার কাছে খুব বেশি কিছু চাইনি কখনও
(তোমাকে ছাড়া) সবই প্রায় পূর্ণ করেছেন তিনি।
আজ এত বছর পরেও ভালোবেসে কাছে ডেকেছ-
মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ,
সবচেয়ে সার্থক প্রেমিক!
: একবার উঠে দাঁড়াবে?
মনটা চাইছে তোমার বুকে জড়িয়ে থাকি...
: এ কী মায়ায় জড়ালে আবার নতুন করে!
ভালোইতো ছিলাম, আবার যদি হারাই...
আবার কবে দেখা হবে?
: যখন তুমি অন্তর থেকে ডাকবে!
আজ তবে চলি-
তুমি ভালো থেকো, অনেক বেশি ভালো...
হাজার বছর
---- লিমা মেহরিন
-আরে অনিন্দ্য না
এই রিকসা দাঁড়ান।
কি ব্যাপার, গেলো কোথায়!
ও কি আমাকে দ্যাখেনি
আমার দিকেই তো তাকালো
কি জানি হয়তো উদাস দৃষ্টি।
এ জনমে বুঝি দেখা হলো না আর।
চলেন ভাই।
-ঐন্দ্রিলা।
-এই যে ভাই দাঁড়ান।
অনিন্দ্য, আমি তো ভাবছি তুমি আমাকে দ্যাখোনি
রিকসাটা ছেড়ে দেই, কোথাও বসে কথা বলি।
-আচ্ছা, তোমার কি মনে নেই,
না দেখেও তোমার উপস্থিতি আমি ঠিকই বুঝতাম
আর আজ চোখের দেখা এভাবে কিভাবে ?
রিকসা ঘুরিয়ে জ্যাম ঠেলে তবেই তোমার কাছে এলাম।
মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম।
জানো বুকের মধ্যে এখনো ধুক ধুক করছে।
-কেনো ?
-যেনো হাজার বছর ধরে তোমাকে খুঁজছি
অন্ধকারের প্রতিটি কণাকে দুহাতে ঠেলে আলোর সন্ধানে ফিরছি
সেই ফেরার পথে তুমি।
ভয় হলো যদি ঝড় ওঠে
আমাকে ছিটকে ফেলে দেয় দূর সীমানায়
আবারো যদি হাঁটতে হয় বছরের পর বছর যুগের পর যুগ।
-আমাকে সত্যিই মনে রেখেছো অনিন্দ্য
আমাকে ভাবো সত্যি ?
অথচ একদিন অবহেলা করেছিলে
কতদিন পরে আজ দেখা।
-আমার অবহেলায় যেদিন অভিমানে মুখ ফেরালে,
সেদিনই বুঝেছিলাম তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন আমার।
জানো, তারপর কোনোদিন বৃষ্টি হয় নি আমার বুকে,
বসন্ত আসে নি, আমাকে জড়াতে আকাশ থেকে নামে নি পূর্ণিমার চাদর।
-এভাবে বলো না অনিন্দ্য,
দুর্বল করো না আমাকে। আমার বদলে যাওয়া পৃথিবীর
খুব গোপনে তুমি আছো।
সেখানে কেউ যেতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমিও পথ হারিয়ে ফেলি।
তোমার কাছে যেতে চায় না মন।
-আমি বিশ্বাস করি না।
তুমি মুখ লুকাতে পারো গভীর সমুদ্রের মতো দিগন্তের বুকে
স্মৃতিগুলোকে ছুঁড়ে দিতে পারো আকাশ গঙ্গার গহীন অন্ধকারে।
তবুও শিশির ভেজা চোখে স্মৃতিহীন গাঙচিল
ভরে দেবে বিষন্নতা। কান্না ভেজাবে চোখ।
স্বপ্ন উড়বে নির্জন ডানায়।
-বুকের প্রশস্ত জমিনে স্বপ্ন বোনা যায়। স্বপ্নেরা জেগে ওঠে
খেলা করে। কি অদ্ভূত ! তাই না অনিন্দ্য ?
-ঐন্দ্রিলা। কেমন আছো তুমি ?
-ওহ্ হো। রিকসা থেকে নেমেই তোমার সাথে কি সব কথা শুরু করেছি।
জানাই হলো না তুমি কেমন আছো
কোথায় থাকো এখন ?
-আমার আর থাকা। কালো মেঘ দেখেছো আকাশে ?
তার নিচেই থাকি আমি।
-হেয়ালি করো না তো অনিন্দ্য।
-ঘর বেধে কি হবে বলো ? কি প্রয়োজন তার,
বরং তোমার কথা শুনি।
কেমন আছো বললে না তো।
-তোমার অবহেলা আমাকে ভালো থাকার শক্তি যুগিয়েছে,
পৃথিবটিা সত্যিই গোল
তাই আবার দেখা হলো।
-বিদায় নেবে বুঝি !
তোমার ফেরার পথ কি রুদ্ধ করা যায় না ঐন্দ্রি ?
দ্বিখন্ডিত করো না এ পথ।
-অনিন্দ্য সত্যিই হাসালে তুমি।
যখন ভাবার কথা তখন ভাবো নি।
যে পথ দু’ভাগ হয়ে হাজার বছর হেঁটে গেছে
তাকে তুমি এক করবে কি করে ?
-আমি তবে তোমার কাছ থেকে হাজার বছর পিছিয়ে ঐন্দ্রিলা ?
যুগের পর যুগ আমি সে পথের পথিক।
-আমি অপেক্ষমান। পথিক তোমার পথ শেষ হোক।
রূপ-নারানের কুলে
---- রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর
রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ-
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন-
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।
ওটা কিছু নয়
---- নির্মলেন্দু গুণ
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও; আমি তৈরী হয়ে নিই।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তোমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার। ওটা নয়, ওটা চুল।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো, - না, না, না,
ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি, - আমার যৌবন।
সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ-প্রেমিক
ওখানে কি খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে, -এর ঠিক ডানপাশে, অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয়।
অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল, তুমিই থাকো নি।
প্রিয়তমাষু
---- সুকান্ত ভট্টাচার্য
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে
আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।
ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে:
-ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি:
কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক
রাত্রে চাঁদ ওঠে: আমার চোখে ঘুম নেই।
তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজ, লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ করে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
নির্ঝরনী
---- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন-
চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিলো মোরে ফেলি তার জাল-
তুলে নিল দ্রুত রথে
দুঃসাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখরচুড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখো চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
বসন্ত-বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রাণ্তে; বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়
সে আমার প্রেম,
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের স্নানস্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়
হে বন্ধু, বিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
পেয়েছে নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহুর্তগুলি গণ্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণি ততো করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
যদি আর বাশী না বজে
---- কাজী নজরুল ইসলাম
বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি অন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি। এই হোক, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতের বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নীরিহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নাম ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋন, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীট্সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ।” জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারনণ অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি, কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে- ঠিক সেই দিনই সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণ ভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলুম। আমার কাব্য, আমার গান, আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শূন্য হতে অসময়ে নেমে আসতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন, পূর্ণত্যের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল। যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারেই বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে, আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।
দূরে উড়ে শঙ্খচিল
---- শিহাব শাহরিয়ার
শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে যায় প্রসন্ন বিকেল
ভিজে যায় বৃক্ষের বুক, অপরাজেয় বাংলার
তিন মূর্তিমান প্রতীক, কলাভবনের শরীর
তখন করিডোরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে...
- তোমার কি কি পছন্দ?
: নীলিমার নীল, বিশুদ্ধ জ্যোৎস্না, স্মৃতির গাংচিল, দূরের শ্মশান
- ধ্যাৎ, এগুলো তো কবিতার শব্দাবলী
: তাহলে... তোমার মা এখন কেমন আছেন?
- পছন্দের কথা বলো?
: পছন্দের কথা?... কবিতা।
- জীবন তো কবিতা নয়?
: কিন্তু কবিতায় তো জীবন থাকে।
- ভিতরের কথা থাক না ভিতরে
: কিভাবে তবে বেঁচে থাকা নৈঃশব্দের নীরব মঞ্চে?
- কেন একা একা জেগে থাকো, কেন একা পথ খোঁজ নিত্য,
ভরা পূর্ণিমার রাতে?
: জানি না... এখনও কেন কার কবিতায় ভিজে হৃদয়,
কোন হরিণি নেচে যায় ছন্দে।
- দোহাই। এইবার শেষ কর কবিতার গল্প
: না, পারো কবিতায় বন্দি করে রাখো।
- তাহলে ভিতরে জন্মাবে কষ্টের পরগাছা, বরং
খুলে দাও উত্তরের জানালা। দ্যাখো-দূরের আকাশ, কাশফুল, চন্দন কাঠ।
: কাব্য নয় আর, ভালোবাসা মরে যায় নিদ্রাহীন ঘরের ভিতরে,
পেতে চায় উড্ডীণ জীবনের লবণাক্ত জল।
- তবে এই নাও সবুজ গলাপ, এই ধরো হাত,
চলো জল শুকিয়ে নদীর বুকে খুলেছে পথ।
: বসন্ত ঝরে যাক প্রাঙ্গণে, তবু তোমাতে ফিরবো না আর।
- দেখ দেখ ঐ যে ফেলে আসা নদী, ভাঙ্গা সেই ঘাট,
প্রাণের চিলেকোঠা পোহাচ্ছে রোদ্দুর।
: আমিও তো চাই ঘাস ফড়িংয়ের সোনালী পাখা, কিন্তু
সব যেন তছনছ হয়ে যায় র্দীঘ বাতাসের শ্বাসে।
- জল যেমন ভাঙ্গে ঢেউ, কিংবা জল পোকারা ভাঙ্গে জল-
তেমনি হৃদয়ের পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে কতদূর পার হয়েছ?
: বিশ্বাস করো, অলিন্দে ফোতটে না কাঁঠালচাপা আগের মতো
অন্ধকারে উঠে না নড়ে বুড়িগঙ্গা সেতু।
- আর কতগুলি মেহগনি হাওয়া, মেহেদীর রাত তোমার চাই
: কখনও চাই না রাত, কেবল তোমাকেই চাই, তোমাকে, তোমাকে।
জলের শরীরে যেমন বেঁচে থাকে মাছ কিংবা শামুক, তেমনি
তোমার শ্রাবণের জলে, আমাকে দাও একটু ঠাঁই।
- তাই বলি- যদি ফের ভালোবাস, যদি ভুল করে
আবার কখনও ফোটাতে চাও গোলাপ, বেদনার বর্ণমালা
শিখে নিও আগে, বৃক্ষের ছায়ায় নির্বাসিত করো মন।
বৃষ্টি থেমে যায়, সংলাপও... কিন্তু থামে না জীবন।
কেবল বৃষ্টি শেষে দুঃখের বৃক্ষ থেকে ঝরে যন্ত্রণার জল,
আর দূরে উড়ে শঙ্খচিল।
বারবারা বিডলার-কে
---- আসাদ চৌধুরী
বারবারা
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত-কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয় ?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।
টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো- বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিঅলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমার মুক্তিযোদ্ধার কাছে এসো-
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্যে
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়ো না-
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জং-ধরা দরজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসো ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করার পূর্বে
ছাত্রপত্রহীন সুর্যকিরণকে বিষাক্ত করার পূর্বে
এসো বারবারা, বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।
ক্ষেত মজুরের কাব্য
---- নির্মলেন্দু গুণ
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা,
আকাশে মেঘের সাথে সূর্যের
জমেছে মধুর খেলা।
ভাঙতে ভাঙতে বিজন মাঠের
কুয়াশা গিয়েছে কেটে,
কখন শুকনো মাটির তৃষ্ণা
শিশির খেয়েছে চেটে।
অতটা খেয়াল রাখেনি কৃষক
মগ্ন ছিল সে কাজে,
হটাৎপুলক পবনে হৃদয়
পুষ্পিত হলো লাজে।
ফিরিয়া দেখিল বঁধূটি তাহার
পিছনে আলের 'পরে
বসে আছে যেন, ফুটে আছে ফুল
গোপনে চুপটি করে।
সামনে মাটির লাল সানকিটি
জরির আঁচলে বাঁধা,
আজ নিশ্চয় মরিচে রসুনে
বেগুন হয়েছে রাঁধা।
হাসিয়া কৃষক মরাল বাঁশের
মুগুর ফেলিয়া দিয়া
কামুক আঁখির নিবিড় বাঁধনে
বাঁধিল বধূর হিয়া।
বরুন গাছের তরুণ ছায়ায়
দু'জনে সারিল ভোজ,
বধূর ভিতরে কৃষক তখন
পাইল মনের খোঁজ।
মেঘ দিল ছায়া, বনসঙ্গমে
পুরিল বধূর আশা-;
মনে যাই থাক, মুখে সে বলিল :
‘মরগে বর্গা চাষা।'
শব্দটি তার বক্ষে বিঁধিল
ঠিক বর্ষার মতো।
'এই জমিটুকু আমার হইলে
কার কিবা ক্ষতি হতো?'
কাতর কণ্ঠে বধূটি শুধালো :
'আইছ্যা ফুলির বাপ,
আমাগো একটু জমিন অবে না ?
জমিন চাওয়া কি পাপ?'
'খোদার জমিন ধনীর দখলে
গেছে আইনের জোরে,
আমাগো জমিন অইব যেদিন
আইনের চাকা ঘোরে।
অসহায় বধূ জানে না নিয়ম
কানুন কাহারে বলে-;
স্বামীর কথায় চোখ দু'টি তার
সূর্যের মতো জ্বলে।
'বলদে ঘোড়ায় গাড়ির চাক্কা,
নারীর চাক্কা স্বামী-;
আইনের চাকা আমারে দেখাও
সে-চাকা ঘুরামু আমি।'
কৃষক তখন রুদ্র বধূর
জড়ায় চরণ দু'টি,
পা-তো নয় যেন অন্ধের হাতে
লঙরখানার রুটি !
যতটা আঘাত সয়ে মৃত্তিকা
উর্বরা হয় ঘায়ে
ততোটা আঘাত সইল না তার
বধূর কোমল পায়ে।
পা দু'টি সরিয়ে বধূটি কহিল :
'কর কি? কর কি? ছাড়ো,
মানুষে দেখলি জমি তো দেবি না,
দুন্যাম দেবি আরও।'
পরম সোহাগে কৃষক তখন
বধূর অধর চুমি !
হাসিয়া কহিল : 'ভূমিহীন কই ?
আমার জমিন তুমি।'
আকাশে তখনও সূর্যের সাথে
মেঘেরা করিছে খেলা,
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা।
ছবি
---- আবু হেনা মোস্তাফা কামাল
আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারি স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাসে অথবা মেম্ফিস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!
আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল
নয় কি?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ
অকৃতিম;
আপনাকে আরো খুলে বলিঃ এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ
এবং যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মত করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।
খাঁটি আর্যবংশদ্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নয়টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন-কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দেখেন নি!
আর দেখুন, এই যে নরমুন্ডের ক্রমাগত ব্যবহার- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির- অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের-থিম!
অসমাপ্ত
---- নির্মলেন্দু গুণ
মননীয় সভাপতি ...। সভাপতি কে? কে সভাপতি?
ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,
আপনাকে আমি সভাপতি মানি না।
তবে কি রবীন্দ্রনাথ? সুভাষচন্দ্র বসু? হিটলার?
মাও সে তুং? না, কেউ না, আমি কাউকে মানি না,
আমি নিজে সভাপতি এই মহতী সভার।
মাউথপিস আমার হাতে এখন, আমি যা বলবো
আপনারা তাই শুনবেন।
উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আমার সংগ্রামী বোনেরা,
(একজন অবশ্য আমার প্রেমিকা এখানে আছেন)
আমি আজ আপনাদের কাছে কিছু বলতে চাই।
আপনারা জানেন, আমি কবি,
রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়ার, এলিয়েটের মতোই
আমিও কবিতা লিখি এবং মূলত কবি,
কবিতা আমার নেশা, পেশা ও প্রতিশোধ গ্রহণের
হিরন্ময় হাতিয়ার! আমি কবি, কবি এবং কবিই।
কিন্তু আমি আর কবিতা লিখবো না ।
পল্টনের ভরা সমাবেশে আমি ঘোষণা করছি,
আমি আর কবিতা লিখবো না।
তবে কি রাজনীতি করবো? কান্ট্রাক্টারী?
পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক?
পত্রিকার সাব-এডিটর?
নীলক্ষেতে কলাভবনের খাতায় হাজিরা?
বেশ্যার দালাল?
ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে তেল-নুন-ডালের দোকান?
রাজমিস্ত্রি? মোটর ড্রাইভিং? স্মাগলিং?
আন্ডারডেভেলপমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা?
নাকি সবাইকে ব্যঙ্গ করে, বিনয়ের সব চিহ্ন-সূত্র
ছিঁড়ে-খুঁড়ে প্রতিণ্ঠিত বুড়ো, বদ-কবিদের
চোখ-নাকে-মুখে কিংস্টর্কের কড়া ধোঁয়া ছুঁড়ে দেব?
- অর্থাৎ অপমান করবো বৃদ্ধদের?
আপনারা কেউ বেশ্যাপাড়ায় ভুলেও যাবেন না,
এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে বেশ্যার দালাল হতে পারি,
রসোন্মত্ত যৌবন অবধি-, একা-একা।
আমার বক্তব্য স্পট, আমার বিপক্ষে গেলেই
তথাকথিত রাজনীতিবিদ, গাড়ল বুদ্ধিজীবি,
অশিক্ষিত বিজ্ঞানী, দশতলা বাড়িওয়ালা ধনী-ব্যবসায়ী
সাহিত্য-পত্রিকার জঘন্য সম্পাদক, অতিরিক্ত জনসমাবেশ
আমি ফুঁ দিয়ে তুলোর মতন উড়িয়ে দেবো।
আপনারা আমার সঙ্গে নদী যেমন জলের সঙ্গে
সহযোগিতা করে, তেমনি সহযোগিতা করবেন,
অন্যথায় আমি আমার ঘিয়া পাঞ্জাবির গভীর পকেটে
আমার প্রেমিকা এবং ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ছাড়া
অনায়েসে পল্টনের ভরাট ময়দান তুলে নেবো।
ভাইসব, চেয়ে দেখুন, বাঙলার ভাগ্যাকাশে
আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, সুনন্দার চোখে জল,
একজন প্রেমিকার খোঁজে আবুল হাসান
কী নিঃসঙ্গ ব্যাথায় কাঁপে রাত্রে, ভাঙে সূর্য,
ইপিআরটিসি’র বাস, লেখক সংঘের জানালা,
প্রেসট্রাস্টের সিঁড়ি, রাজিয়ার বাল্যকালীন প্রেম।
আপনারা কিছুই বোঝেন না, শুধু বিকেল তিনটে এলেই
পল্টনের মাঠে জমায়েত, হাততালি, জিন্দাবাদ,
রক্ত চাই ধ্বনি দিয়ে একুশের জঘন্য সংকলন,
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিনে নেন।
আমি শেষবারের মত বলছি
আপনারা যার-যার ঘরে, পরনে ঢাকাই শাড়ি
কপালে-সিঁদুরে ফিরে যান। আমি এখন অপ্রকৃতিস্থ
পূর্ব-বাঙলার অন্যতম ভীষণ মাতাল বক্তা একজন,
ফুঁ দিয়ে নেভাবো আগুন, উন্মাদ শহর,
আপনাদের অশ্লীল-গ্রাম্য-অসভ্য সমাবেশ,
লালসালু ঘেরা স্টেজ, মাউথ অর্গান, ডিআইটি,
গোল স্টেডিয়াম, এমসিসি’র খেলা,
ফল অফ দি রোমান এ্যাম্পায়ারের নগ্ন পোষ্টার।
এখন আমার হাতে কার্যরত নীল মাইক্রোফোন
উত্তেজিত এবং উন্মাদ।
শ্রদ্ধেয় সমাবেশ, আমি আমার সাংকেতিক
ভয়াবহ সান্ধ্য আইনের সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
মাধবীর সারা মাঠ খালি করে দেবেন।
আমি বড় ইনসিকিওরড, যুবতী মাধবী নিয়ে
ফাঁকা পথে ফিরে যেতে চাই ঘরে,
ব্যক্তিগত গ্রামে, কাশবনে।
আমি আপনাদের নির্বাচিত নেতা।
আমার সঙ্গে অনেক টাকা, জিন্নাহর কোটি কোটি
মাথা; আমি গণভোটে নির্বাচিত বিনয় বিশ্বাস,
রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, অথচ আমার কোনো
সিকিউরিটি নেই, একজন বডিগার্ড নেই,
সশস্ত্র হামলায় যদি টাকা কেড়ে নেয় কেউ
-আমি কী করে হিসেব দেবো জনতাকে?
স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি হলে কন্যার কাঁকন যাবে খোয়া,
আপনার আমার সকলের ক্ষতি হবে,
সোনার হাতে সোনার কাঁকন আর উঠবে না।
আপনারা ভাবেন, আমি খুব সুখে আছি,
কিন্তু বিশ্বেস করুন, হে পল্টন,
মাঘী পূর্ণিমার রাত থেকে ফাল্গুনের পয়লা অবধি
কী ভীষণ দুর্বিষহ আগুন জ্বলছে আমার দুখের দাড়িতে,
উষ্কখুষ্ক চুলে, মেরুদণ্ডের হাড়ে, নয়টি আঙুলে,
কোমরে, তালুতে, পাজামার গিঁটে, চোখের সকেটে।
দেখেছি তো কাম্যবস্তু স্বাধীনতা, প্রেমিকা ও গ্ণভোট
হাতে পেয়ে গেল নির্জন হীরার আগুনে
পুলিশের জীপ আর টায়ারের মতো পুড়ে-পুড়ে যাই,
অমর্যাদা করি তাকে যাকে চেয়ে ভেঙেছি প্রসাদ,
নদী, রাজমিস্ত্রী এবং গোলাপ।
আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীন হতে ভালোবাসি।
প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে মনে হয় বিরহের
স্মৃতিচারণের মতো সুখ কিছুই নেই।
বাক-স্বাধীনতা পেলে আমি শুধু প্রেম, রমণী, যৌনতা
ও জীবনের অশ্লীলতার কথা বলি।
আমি কিছুতেই বুঝিনা, আপনারা তবু কোন বিশ্বাসে
বাঙলার মানুষের ভবিষ্যৎ আমার স্কন্ধে চাপিয়ে দিলেন।
আপনারা কী চান?
ডাল-ভাত-নুন?
ঘর-জমি-বউ?
রূপ-রস-ফুল?
স্বাধীনতা?
রেফ্রিজারেটর?
ব্যাংক-বীমা-জুয়া?
স্বায়ত্তশাসন?
সমাজতন্ত্র?
আমি কিছুই পারি না দিতে,আমি শুধু কবিতার
অনেক স্তবক, অবাসস্ত অন্ন বস্ত্র বীমাহীন জীবনের
ফুল এনে দিতে পারি সকলের হাতে।
আমি স্বাভাবিক সুস্থ সৌভাগ্যের মুখে থুথু দিয়ে
অস্বভাবিক অসুস্থ শ্রীমতী জীবন বুকে নিয়ে
কী করে কাটাতে হয় অরণ্যের ঝরের রাত্রিকে
তার শিক্ষা দিতে পারি। আমি রিজার্ভ ব্যাংকের
সবগুলো টাকা আপনাদের দিয়ে দিতে পারি,
কিন্তু আপনারাই বলুন অর্থ কি বিনিময়ের মাধ্যম?
জীবন কিংবা মৃত্যুর? প্রেম কিংবা যৌবনের?
অসম্ভব, অর্থ শুধু অনর্থের বিনিময় দিতে পারে।
স্মরণকালের বৃহত্তম সভায় আজ আমি
সদর্পে ঘোষণা করছি, হে বোকা জমায়েত,
পল্টনের মাঠে আর কোনোদিন সভাই হবে না,
আজকেই শেষ সভা, শেষ সমাবেশে শেষ বক্তা আমি।
এখনো বিনয় করে বলছি, সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
আপনারা এই মাঠ খালি করে দেবেন।
এই পল্টনের মাঠে আমার প্রেমিকা ছাড়া
আর যেন কাউকে দেখি না কোনোদিন।
এই সারা মাঠে আমি একা, একজন আমার প্রেমিকা।
যা চেয়েছি, যা পাবো না
---- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কী চাও আমার কাছে ?
কিছু তো চাইনি আমি !
চাওনি তা ঠিক।
তবে কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
জানি না। ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো দূরবর্তী নৌকো
চতুর্দিকে তোমাকেই দেখা।
সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
মনে হয় তুমি দেবী-
আমি দেবী নই।
তুমি তো জানো না তুমি কে !
কে আমি !
তুমি সরস্বতী
শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নীরা নামে ডাকি।
হাসি পায় শুনে
যখন যা মনে আসে
তাই বলো ঠিক নয় ?
অনেকটা ঠিক। যখন যা মনে আসে-কেন মনে আসে ?
কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
আশীর্বাদ !
আশীর্বাদ ! আমার, না সত্যি যিনি দেবী।
তুমিই তো সেই। টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি, উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও।
যথেষ্ট পাগল আছো। আরও হতে চাও বুঝি ?
তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন শান্তশিষ্ট
না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
যে জীবন মানুষের ?
আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
তোমার ভিতরে তুমি,
শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা ?
শোন্ খুকী
এই মাত্র দেবী বললে...
একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
কী আছে আমার ? জানি না তো
তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব, শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ?
আমি ধনী হবো
আমার তো দুঃখ নেই !
দুঃখের চেয়েও কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর কী দেবো তোমাকে ?
তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু'হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
কিছু নয় !
অভিমান ?
নাম দাও অভিমান !
এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
মৃত্যু ?
ছিঃ , বলতে নেই
তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
পাওনি কি ?
বুঝতে পারি না ঠিক। বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
ফের পাগলামি ?
দেখা দাও।
আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
না !
কেন ?
বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর ঐ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তবু এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে...
তুমি কবি ?
তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
কী চাও আমার কাছে ?
কিছু নয়। আমার দু'চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?
তৃষিত তিমির
---- আসমা বেগম শীলা
: হ্যালো
- হ্যাঁ বলছি
: এখনো জেগে আছো?
- সন্দেহ আছে? ভূতের গলার সঙ্গে মিলিয়ে ফেল নাকি?
: রেগে যাচ্ছ কেন? বলেছিইতো ক্লাস শেষ হলে রিং করব।
তাছাড়া সেদিন বললে না তোমার রাতের পড়া নষ্ট করি।
- করই তো
: কি বই পড়ছিলে?
- হুম, হিউম্যান সাইকোলজি
: এও পড়তে হয় নাকি
- পরীক্ষা পাশের জন্য নয় মনুষ্য হৃদয় জানিবার জন্য হে-
: কতটা পারলে? ডিস্টার্ব করছি না তো ?
- ওহু, সাহায্য করছ
: কেমন?
- তুমি গিনিপিগ। হিউম্যান সাইকোলজির প্র্যাকটিক্যাল এলিমেন্ট
: কি হলো? কথা বলছ না যে?
- তোমার সংস্কৃতি চর্চার কতদূর এগুলো?
: মাইল খানেক
- সে যাক পলির খবর কি?
: ভালো। তোমার কথা প্রায়ই বলে, কথা বলতে চায়।
- তাই নাকি?
“নিজের সাথে যুদ্ধ করি
তোমার সাথে মিত্রতা
নিজ হৃদয়ে মিথ্যে প্রবোধ
মানুষ বলে হিংস্রতা”
পলিকে বলো সাত দিনের প্রজেক্টে সব আধুনিক কবিতা
মুখস্ত করে ফেলব-
নিশ্চয়ই বাতিক আছে।
: বিয়ে করছ তাহলে ব্রহ্মচারী?
- নয়তো কি? তুমিই তো বলো বয়স্ক পুরুষ বড় নিঃসঙ্গ,
স্বস্তির জন্য, নিঃশ্বাসের জন্য ক্লান্তিতে হেলান দেয়ার
জন্য একজন সুবোধ সঙ্গী চাই। তা ছাড়া পলি! –যাকে
বলে সাক্ষাত অন্নপূর্ণা। রন্ধনে সিদ্ধহস্ত বিদ্যায় গরিয়সী,
সামাজিকতায় সমকালীন, ভূষণে আধুনিক আর
চিত্তহরণে আজরা জ্যাবিন।
: মানে?
- মানে যাদুকরী, আমার চিত্ত লুপ্তপ্রায়।
: ইয়ার্কী কর না। ওর মায়ের সাথে কথা বলব?
- তার আগে বলো আমাদের বিয়েতে কি দিচ্ছ?
: কেন?
- সেটা নিজে কিনে নিতে চাই
: মানে?
- মানে ৫৮০/= টাকা টেলিফোন বিল শোধ দিতে চাই
আমাকে রিং করে তোমার যে অর্থ দন্ডি হয়েছে।
: শোধ কেন?
- ঋণীই বা থাকবো কেন?
: প্রয়োজন তো আমার ছিল
- কিসের প্রয়োজোন?
এই একটু হৃদয় নাড়ানোর, স্বপ্নের উদ্যানে বীজ ছড়ানোর
কুয়াশার ক্যানভাসে কুয়াশা আঁকার কি এমন তুমুল
প্রয়োজন ছিল?
: তুমিই কি কখনো ভেবেছ আমার তৃষ্ণার্ত সূর্যের এক
একটি মৃত্যুর কথা
কখনো জানতে চেয়েছ কোন অহংকারে
কোন স্বপ্ন বুকে নিয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকি আমি।
- আমি যদি একই প্রশ্ন তুলি?
: তুমিতো ব্রহ্মচারী, অনাসক্ত হৃদয় তোমার
এতো প্রাণ কোথা পাবো তোমাকে ভাসাই?
- অন্ধকারে অন্ধকার ঘষে কখনো কোথাও আলো জ্বলে।
তমা তুমি শুধু জ্বলাতে পার, পার না?
---- জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূরে অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
ভালোবাসার শপথ
---- ফারজানা সুলতানা
সূর্য তখন বিদায়ের প্রহর গুণছে,
বাতাসে শীতের আনাগোনা;
রিক্ত প্রকৃতির মাঝে বসে আছি আমরা দু’জন-
ভালোবাসার ঐশ্বর্য্যে পূর্ণ হয়ে।
শব্দহীন পৃথিবীর ইন্দ্রজ ছিঁড়ে শুধালাম-
‘চুপ করে কেনো ? কিছু বলছো না যে !
আজ কি তোমার মন ভালো নেই ?”
ভাবনার সমুদ্রে অবগাহন শেষে অনিন্দ্য বলে উঠল
(দীঘশ্বাস ছেড়ে) “ঠিক তা নয়; যখন অতীতটাকে ফিরে দেখি,
যখন চষে বেড়াই বর্তমানের বিস্তীর্ণ-জমিন
তখন নিজেকে কেমন একা একা লাগে !
কিংবা ধর, যখন ভবিষ্যতের সাদা ক্যানভাসে
চেষ্টা করি স্বপ্ন আঁকবার তখন বারবার স্বপ্নটা কেবল
ঝাপসা হয়ে যায়, শুধুই বিবর্ণ হয়ে যায়!
: কেনো নিঃসঙ্গ ভাবো নিজেকে ?
আমি আছি, আমার ভালোবাসা আছে-
এ সত্যটা কি তোমাকে ভরসা দিতে পারে না?
: সেখানেই তো ভাবনাগুলো গভীরে চলে যায়-
কিংবা হোঁচট খায়।
মাঝে মাঝে ভালোবাসার অস্তিত্ব অনুভব করি প্রকট ভাবে
আবার কখনো সেই ভালোবাসাকেই মনে হয় মরীচিকা !
: কিসের এত দ্বিধা তোমার, কিসের সংশয় !
কেনো এই অনর্থক ভাবনা ?
এই যে ঘাস ফড়িংয়ের মত নিরন্তর ছুটে চলেছি
বাড়িয়ে দিয়েছি মমত্বের হাত, বিছিয়ে রেখেছি সোহাগের আঁচল-
এও কি তোমাকে আশ্বস্ত করতে পারে না !
আমার ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ, অনিন্দ্য ?
: চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে-
সত্যি কি ভালোবাসো আমাকে- শুধুই আমাকে ?
আমার ভালোবাসা কি তোমাকে পূর্ণতা দেয় ?
ভরসা দেয় নিঃসঙ্গতায় ?
সূর্যের মতো আলো দেয়Ñযখন পথ হারাও সাদা কুয়াশায় !
: সারাদিন কাটে আমার কার ভাবনায় ?
কার প্রেমে কার ভালোবাসায় আমি মগ্ন হয়ে থাকি !
একাকী মুহূর্তে বুকে হাত রেখে অনুভব করি কার হৃদস্পন্দন?
আমার নিঃসঙ্গতায় কার ছায়া সঙ্গ দেয় সারাক্ষণ !
সাদা কুয়াশায় পথ হারানো আমি খুজি কার হাত-
কার স্পর্শে অপূর্ণ এই আমি পূর্ণ হয়ে উঠি.....
প্রিয় অনিন্দ্য আমার, তুমি কি বোঝো এই আমাকে-
আমার সারা দেহে, প্রাণে সারাক্ষণ খুঁজে ফিরি
তোমাকে, শুধুই তোমাকে।
: ভাবতে বড় ভালো লাগে,
স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। ভালো লাগে
প্রজাপতির ডানায় ভর করে ভেসে বেড়াতে-
তোমার ভালোবাসাকে সঙ্গী করে।
সত্যি যদি তাই হয় তবে আমাতেই মগ্ন হয়ে থাকো-
পূর্ণ প্রানে, বিশ্বাসে, ভালোবাসায়।
কিন্তু কখনও যদি এ ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায়
তাহলে ভেবে নেব পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কিছু নেই
কিছু ছিলো না কোনোকালেই আর
থাকবেও না কোনোদিন !
: আর অনিন্দ্য;
এসো, সব দ্বিধা ভুলে আবার আমরা
ডুবে যাই গভীর ভালোবাসায়;
আবার স্বপ্ন দেখি নতুন করে ঘর বাঁধবার
ভরা জোছনা রাতে, যে রাতে আমরা ভেসে যাবো
উচ্ছাস ও আবেগে সীমাহীন জোয়ারে।
প্রেম, ফিরে এসো
---- অসীম তরফদার
: টেলিফোনের তার বেয়ে
ওপার হতে ভেসে এলো তোমার কন্ঠস্বর;
আমার স্নায়ু, শিরায় চঞ্চল হরিণীর ছুটাছুটি,
হৃদয়ের নীপবনে ময়ূরীর উন্মাতাল নাচন;
যেন এরকম মূহুর্তের জন্য
উন্মুখ হয়ে আছি কতদিন.. কতযুগ.. কতটি বছর…
: সত্যি আমার কথা এখনও ভাবো তুমি?
: জীবিকার টানে আর
সমাজজীবনে একটুখানি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
কিংবা উল্টো স্রোতে টালমাটাল লড়ে
বাঁচার মত বেঁচে থাকার আশায়
সতত কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত থাকা আর
অথৈ জলে হাবুডুবু খাওয়া -
এর মাঝে কারও কথা ভাবার অবসরই হয় না,
এমনকি নিজেকে নিয়েও নয়;
এভাবে অহর্নিশ প্রতিকূল সময়ের সাথে লড়াই করে
এক সময় ভেতরে ভেতরে আমি মরে যাই,
ঠিক তখনই কোন না কোন ভাবে তুমি সামনে চলে আসো
আর জাগিয়ে দাও আমায়, আমার তখন পুনর্জন্ম হয়;
তখন আমি বুঝতে পারি -
আমারও একটা সোনালি অতীত আছে;
একদা আমার মনে প্রেম ছিল, আনন্দ ছিল
কষ্ট ছিল, স্বপ্ন ছিল এবং তুমি ছিলে।
: কেন তোমার এই নিরন্তর সময়ের স্রোতে
নুড়ি পাথরের মত ক্ষয়ে যাওয়া?
সে কি কেবলই অর্থ-বিত্ত আর প্রতিপত্তির নেশা?
: ঠিক নেশা নয়, তবে প্রয়োজন।
জন্মেছি বিত্তহীন বাবার সংসারে
আজন্ম ছিল তাঁর অর্থের অভাব আর আদর্শের স্বপ্ন;
দারিদ্র্যের সাথে আমৃত্যু লড়াই করে আমার চোখের সামনে
তিনি মারা যান বিনা-চিকিৎসায়, পথ্যবিহীন;
বুক ভরা ভালোবাসা, এমনকি
সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও তোমাকে হারালাম
শুধু দারিদ্র্যে, বিত্তহীনতায়।
আর সে থেকেই জানলাম, (জানিনে কতটা সঠিক)
জীবনে আদর্শ অপেক্ষা বিত্তের প্রয়োজন বেশি,
বিত্তহীন আদর্শ নিয়ে মিথ্যে অহমিকা চলে
কিন্তু জীবন চলে না।
: কত বেশি সম্পদ হলে মানুষ বিত্তশালী হয়
অথবা নিজেকে সুখি মনে করে?
ঠিক আছে, তোমার নিজের কথাই বলো -
আর কতটা হলে থামবে তোমার
বিত্ত-বাসনায় এই চোখ-বাঁধা দৌড়?
সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিহীনতায় বৈভবের স্বপ্ন দেখা?
: বৈভবের স্বপ্ন দেখি না কখনও।
সমাজে একটুখানি সম্মান নিয়ে চলা
কিংবা একটু ভালোভাবে বাঁচা, পেট পুরে খাওয়া,
আর এজন্য ন্যূনতম যতটুকু প্রয়োজন
ততটুকু পেতেই আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে,
প্রাচুর্যের স্বপ্ন দেখার অবকাশ কোথায়?
থাক, বাদ দাও ওসব কথা,
ছেড়েছি জীবনের হাল, যাক না যেদিকে খুশি;
এবার অন্য কথা বলো।
: প্রতিদিনের স্বাভাবিক ব্যস্ততায় বয়ে চলে নিরন্তর সময়,
কখনও প্রচন্ড খরতাপ, কখনও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
কখনও আবার বিরামহীন বর্ষণ;
বর্ষার উন্মাতাল প্রকৃতির মতই খেয়ালিপনায়
কেটে যায় আমার দিন-রাত।
তুমি বিত্তের পেছনে ছোটো দারিদ্র্য ঘোচাতে
আর আমি প্রাচুর্যের বৃত্তে-বন্দিনী
খুঁজি একটুখানি সুখ, মমতা খুঁজি
আর বিত্তহীন তোমার ভালোবাসা-
নিজের পায়ের ঘোলা করা জলে।
লক্ষীটি, তুমি আবার হাল ধর শক্ত করে,
আবার তুমি কলম নাও হাতে
দেখো, একদিন সৃষ্টির মাঝেই পাবে সুখ
ঘুচবে তোমার দারিদ্র্য, অর্জিত হবে খ্যাতি;
দেখবে সৃষ্টিতেই সুখ, বিত্তের চেয়ে;
লক্ষীটি, বলো, আবার তুমি লিখবে।
: তোমার ইচ্ছের কাছে বারবার আমি পরাজিত হই।
কিন্তু নৈসর্গের কাছে শব্দ ও ছন্দের প্রার্থনা করে
বড্ড নিরাশ হই আজকাল।
বিশ্বাস কর, ইদানিং আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে লিখতে বসি
অথচ কাক্সিক্ষত শব্দেরা তবু অধরাই থেকে যায়,
বুঝি ব্যর্থ হই আমি।
তবু না হয় আবার চেষ্টা করব
বীজ বুনব অনুর্বর শুষ্ক জমিতে
আবার ফলাব ফসল বিরাণ মাঠে
তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য।
বিসর্জন
---- অসীম তরফদার
পশ্চিমের ঘাট ধরে সূর্যটা ডুবেছে অনেক আগেই
পাখিরাও ঝাঁক ধরে ফিরে গেছে নীড়ে
নদীর ধারে যারা এসেছিল তারাও ফিরে গেছে একে একে।
সন্ধ্যা নামার আগেই চলে গেছে নিপা,
একদা যাকে আমি ভালোবেসে হৃদয়মন্দিরে আসীন করেছিলাম
আরাধনা করেছিলাম আজন্ম তার ভালোবাসায় আপ্লুত হব বলে,
গোধূলির ধূসর আলোয় আমার সেই স্বপ্নচারিণী দেবীর
বিসর্জন হল আজ, এই নদীতীরে, মাত্র কয়েক মূহুর্ত আগে।
এমনই এক গোধূলি লগনে
নিপা একটি লাল গোলাপ দিয়ে বলেছিল -
“এটা গোলাপ নয় – এ আমার হৃৎপিণ্ড, আমার জীবন!
আজ থেকে ওটা তোমার কাছেই বন্ধক রাখলাম।”
হেমন্তের শেষ বিকেলের হলুদ বাদামী আলো এসে পড়েছিল
তার চোখে-মুখে, মনে হল চোখ দুটো ঝর্ণার জলের মত স্বচ্ছ,
সে চোখের গভীরে সেদিন আমার ভালোবাসা খুঁজেছিলাম
আর পরম তৃপ্তিতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে
চুম্বন এঁকেছিলাম কপালে।
একবার একটা কাজে নিপাদের দক্ষিণের ঘরে থাকতে হয়েছিল
কয়েকটা দিন, সে ঘর থেকে নিপার ঘরটি দেখা যায়-
সুযোগ পেলেই জানালা দিয়ে চোখের ইশারায়
কত কথা বলেছি তার কোন হিসেবই নেই।
নিপা খুব বেশি সুন্দরী ছিল না কিন্তু সাজতে ভালোবাসতো,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতো সুন্দর করে
আর আমি অব্যক্ত মুগ্ধতায় তাকে দেখতাম শুধু।
ফাইনাল পরীক্ষার আগে নিপা শেষরাতে উঠে পড়ত
যদিও ছাত্রী হিসেবে বিশেষ সুবিধের ছিল না সে,
পড়া শেষ করে ভোর বেলায় একদিন
দক্ষিণের ঘরের জানালায় এসে জাগালো আমায়;
আর কেউ জাগেনি তখনও
নিপা আমাকে নিয়ে গেল তার শেফালী গাছের নীচে।
পূবের আকাশ কিছুটা লাল হয়েছে সবে, বাতাসে হালকা কুয়াশা
শেফালী পাতা বেয়ে দু’এক ফোঁটা শিশির ঝরছে মাথায়
পড়ছে কিছু শেফালী ফুলও ঝরে
নিপা কয়েকটি ফুল তুলে নিল হাতে,
আমার হাতটি নিয়ে রাখল তার হাতের উপর
ভোরের সে আলোয় নিপাকে দেখাচ্ছিল ভীষণ শুভ্র ও স্নিগ্ধ।
সে তার কোমল হাতে আমার হাতখানি নিয়ে খেলায় মেতে রইল
কিছুটা সময়, তারপর চোখ তুলে তাকালো আমার চোখে;
“তোমার এ হাতখানি আমি ছাড়ব না কিছুতেই
সারাজীবন পাশে থাকব, যত বাধাই আসুক, দেখো;
তুমি আমায় ভূলে যাবে না তো? ছেড়ে যাবে না তো কোনদিন?
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না একদিনও।”
আমরা মোহাবিষ্ট হই এক মধুর স্বপ্ন ও কল্পনায়।
কবিতা ভালোবাসতো নিপা,
প্রায়ই আমার কবিতা নিয়ে পড়ত সে
কবিতা গুলো জীবন্ত হতো তার কন্ঠে, উৎসাহ পেত প্রশংসায়।
বর্ষার এক বিকেলে সে বলেছিল -
“আজ তোমায় সাথে করে নিয়ে যাব প্রেমনগরে
আসল নাম নয় এটি, তবে যুগলেরা এ নামেই চেনে জায়গাটাকে!
শুনেছি সেখানে নদীর কুলে কাশবনে সাদা সাদা ফুলগুলো
দোল খায় দখিনা বাতাসে, গাংচিল বেড়ায় উড়ে
নদীর জলে আপন মনে ভেসে যায় হংসসারি,
সেখান থেকে দেখা যায় দূরে মাঝনদীর চর;
যুগলেরা সেখানে প্লাবিত হয় ভালোবাসায়
আজ আমরাও আবিষ্ট হব, তোমাকে দেব আমার প্রথম চুম্বন।”
সেদিন আমার মনে আনন্দের বান ডেকেছিল
বুকের মধ্যে ঝিলিক দিয়েছিল আশা-আপ্লুত স্বপ্নেরা;
হঠাৎ অঝোর বর্ষণ সেই স্বপ্নকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল
প্রেমনগরে যাবার বদলে আমরা ভিজতে ভিজতে
ফিরে এলাম ঘরে।
আমাকে ভালোবাসে জেনে একদিন ওর মা বকেছিল খুব
সেদিন আমার কাছে এসে অনেক কেঁদেছিল নিপা,
কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিল-
“যে যা খুশী বলুক, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচব না;
যতদিন বাঁচব ততদিন শুধু তোমারই হয়ে থাকব
তুমি শুধু এমনি করেই ভালোবেসো আমায়।”
আমাদের ভালোবাসার স্বপ্নীল উঠোনে তখন
নেচে বেড়াত ফিঙ্গে, শ্যামা, বুলবুলি, কাকাতোয়া;
আমাদের আকাশে উড়ত রং-বেরংয়ের ঘুড়ি
হেমন্ত দিনের মত মেঘমুক্ত সে আকাশে কেবলই
খেলা করত সোনালী রোদ্দুর।
হঠাৎ একদিন সেই নির্মল আকাশ ছেয়ে গেল কাল মেঘে;
আমাদের আপনজনেরা, যারা নিজেদের দাবি করেন
আমাদের মঙ্গলাকাক্সক্ষী বলে, তারা
আমাদের মনের চাওয়াকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে
দুজনার মাঝখানে গড়ে দিলেন দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর।
আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম,
আমার কানে আর ঝংকার তুলে না তার সহাস্য কথামালা
নীলখামে আর আসে না তার চিঠি
গেঁথে দেয় না শিউলী মালা নি:সীম মমতায়।
আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না,
নিপা আর এলো না, হয়ত আসার চেষ্টাও করল না।
তারপর…
পেশাগত কাজে আমি নির্বাসিত হই।
হঠাৎ ক’দিন আগে খবর পেলাম-
নিপা ডেকেছে আমায়, খুব জরুরী।
কিছুটা উৎফুল্ল ও খানিকটা ব্যাকুল চিত্তে ছুটে এলাম আমি;
হয়ত সেখানে জেগেছে এক নতুন সম্ভাবনা
আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন এক পথ,
যে পথ একদা বিলীন হয়েছিল চার বছর আগে।
বুকের মাঝে অসীম আশার ডালি সাজিয়ে
প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গুনে যখন এলাম নিপার কাছে
তখন তাকে মনে হল ঝরা পাতা, বিমর্ষ
ও বৈরী বাতাসের মত অস্থির,
শ্বেত গোলাপের পাপড়ি গুলো অকারণে ছিঁড়তে লাগল
আর সেদিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে বলল-
“কি করে যে তোমায় বলি?
আসলে খুব বড় একটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছি আমি
তুমি চেন তাকে, শোভন, আমার ভালোবাসার জন্য
যে সব সময় কাঙালের মত ঘুরত।
তোমার সাথে যখন বন্ধ হয়ে গেল সব যোগাযোগ
তখন কি করে যেন জড়িয়ে গেলাম আমি,
ভীষণ ভালোবাসে আমায় এবং আমিও তাকে;
তাইতো মুক্তি নিতে এসেছি আজ।
তোমার জন্যেও বড্ড মায়া হয় আমার, তোমায় ঠকিয়েছি আমি
ক্ষমা করে দিও আর আমাদের আশীর্বাদ করো।”
নিপা শুধু একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে
সে চোখের তারায় আমি আবার আমার ভালোবাসা খুঁজলাম
সেখানে তার আর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
ফেলে যাওয়া শ্বেত গোলাপটি পড়ে রইল পথের ধুলায়
অনাদরে, অবহেলায়।
তোমার কাছে আমার একটা পাওনা রয়ে গেল
তোমার সাথে প্রেমনগরে যাওয়া হল না আর,
আজ হল জলাঞ্জলী আমার সকল সুপ্ত আকাক্সক্ষার।
নিপা, এখনও কি তুমি পড়তে বস শেষরাতে উঠে?
তোমার শেফালী গাছে এখনও কি ফুল ফোটে
নাকি ফোটে না আর?
শিশির কি ঝড়ে পড়ে না এখন শীতের প্রভাতে?
তুমি কি করে পারলে, নিপা !
শোভনলাল কেমন অনায়াসে আমার বুক থেকে
তোমায় কেড়ে নিয়ে গেল,
আমি বড় একা হয়ে গেলাম
পৃথিবীতে আপন বলে ভাবার মত কেউ রইল না আর
আমার স্বপ্নের সাজানো বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল
আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
তবুও নিপা, তোমাদের জন্য আমার আশীর্বাদ।
প্রেম এসেছিল নীরবে
---- অসীম তরফদার
কাজের ব্যস্ততায় ডুবে থেকে থেকে
আজ আমি বড় ক্লান্ত।
তাই কোন কাজ নয় আজ; ছুটি নিয়েছি
অফিস, সংসার এমনকি পরিচিত গণ্ডি থেকেও।
বেড়িয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে,
কিছুটা সময় এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা
তারপর চলে এলাম ধানমন্ডি লেকের ধারে,
পাশেই একটা কারুপণ্য প্রদর্শনী, ঢুকে গেলাম কিছু না ভেবেই।
নক্শী করা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ চোখে পড়ল,
কাছে গিয়ে ধরতে গেলাম ব্যাগটি
ঠিক সেই মূহূর্তেই অন্য একটি হাত এসে ধরে ফেলে সেটি
আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ
মনে হল, এ হাতখানি যেন আমার অনেক দিনের চেনা।
তখনও ঘোর কাটেনি আমার, অপলক তাকিয়ে আছি
সেই হাতের দিকে ।
ঘোর কাটল এক সুরেলা কন্ঠের মধুর ঝংকারে-
“আরে আপনি! কেমন আছেন? কতদিন পর দেখা?”
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি দীপান্বিতা!
কোন কিছু বলার সুযোগ দিল না, সঙ্গে করে নিয়ে গেল ডিঙিতে।
দুপুরের প্রখর রোদ, ঝিরিঝিরি বাতাস, লেকের জলে মৃদু কম্পন
আর ডিঙিতে পাশাপাশি বসেছি আমরা দু’জন।
আজ এগার বছর পর দেখা-
কতটা বদলে গেছে দীপান্বিতা এখন
সেদিনের চাপা স্বভাবের মেয়েটি আজ বড় সাবলীল।
“আপনার বৌ নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী?
ভীষণ ভালোবাসে বুঝি আপনাকে?
কোন মেয়ে কি আপনাকে ভালো না বেসে পারে!
আপনার রূপের আর গুণের প্রশংসায় সব সময় ব্যস্ত থাকত
আমার চেনা জানা মেয়েরা
আর আমি হিংসায় ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরতাম-
কেন সবাই এমন করে শুধু নজর দেয়
আমার পছন্দের মানুষটির দিকে!
কি ছেলে মানুষি ভাবনা! ”
শব্দ করে হেসে ওঠে দীপান্বিতা -
“মনে হলে ভীষণ লজ্জা হয় এখন
তবে আপনি যে কেমন মুডি ছিলেন না -
ভালোলাগার কথা বলাতো দূরের কথা বোঝাতেও সাহস করিনি।
কেবলই মনে মনে স্বপ্ন এঁকে গেছি
আর মন্দিরে দেবতার সামনে বসে
আপনার জন্য প্রার্থনা করেছি দিনের পর দিন,
সদয় হলেন না ঈশ্বর! পোড়া কপাল আমার!”
দীপান্বিতা তখন বর্তমানে নেই, চলে গেছে অন্য জগতে
কয়েকটি মূহুর্তের জন্য আমিও ভুলে গেছি, কারও স্বামী আমি
কিংবা দীপান্বিতা অন্য এক পুরুষের স্ত্রী,
হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছি দীপান্বিতার হাত।
শুধু একটি বারের জন্য সাহসী হতে পারলে না, দীপান্বিতা?
শুধু একবার বোঝাতে পারলে না কোন ইশারায়
অথবা আমার চোখ দেখে বুঝতে পারলে না
যে কথাটি আমি বলতে পারিনি হাজার বার চেষ্টা করেও?
ব্যক্তিত্বের খোলস ভেঙ্গে প্রকাশ করতে পারিনি
আমি যে তোমায় ভালোবাসি দীপান্বিতা!
“সত্যি নির্দয় নন বিধাতা, তিনি শুনেছেন আমার প্রার্থনা-
পাইনি হয়ত পার্থিব জগতে তোমায়
তবু বুকের মধ্যে লালন করছি যে তোমাকে
সেই তোমার বুকের মাঝেও আমার জন্য অবারিত ভালোবাসা-
এটাই আমার পরম প্রাপ্তি, এতেই আমার সুখ।
এই যে ভালোবেসে আজ তুমি হাতটি ধরেছো আমার
এই ছোঁয়াটুকু থেকে যাবে সারাজীবন।”
দীপান্বিতার চোখ থেকে ঝরে পড়ে মুক্তোদানা
আমার মুখেও কিছু আসে না বলার মত,
এক ঝাঁক কাল মেঘ যেন ছেয়ে দিল আকাশ
ঢেকে দিল মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল সূর্যকিরণ।
এক বিকেলে রুদ্র ও নন্দিতা
---- অসীম তরফদার
: আজ তোমার কি হল রুদ্র-
এমন উদাস আর মন মরা হয়ে আছো যে!
বাসায় একগাদা মিথ্যে বলে, দু:সহ যানজট ঠেলে
এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে ছুটে এলাম;
সামনে বহমান নদী,
ঢেউয়ের জলে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম কিরণ
নদীর বুক চিরে দূর হতে ছুটে আসা শীতল হাওয়ার পরশ;
কোথায় দুটো রোমান্টিক কথা বলবে তা নয়
তুমি শুধু…
: ভেবেই যাচ্ছি, কি করে তোমার রূপের বর্ণনা করা যায়
আর তোমার পাশে কেমন বেমানান মনে হয় আমাকে!
: ফাজলামো হচ্ছে, না?
তোমাকে বেমানান নয়, মাঝে মধ্যে বরং নিজেকেই
অসম মনে হয় তোমার সামনে।
সত্যি আজ তোমার কত খ্যাতি চারিদিকে,
পেশা মর্যাদা আর ব্যক্তিত্বের দিক থেকে
তুমি ছাপিয়ে যাও আমায়।
তুমি হয়তো সর্বোত্তম নও তবে সুপুরুষ,
হয়তো বিত্ত বৈভবের দিক থেকে অতটা বড় নও তুমি
কিন্তু তোমার হৃদয়টা ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র-
যেখানে সারাজীবন আমি সাঁতার কেটে গেলেও
ছুঁতে পারব না তার শেষ সীমানা।
: নন্দিতা, এটা কিন্তু তোমার বাড়িয়ে বলা অথবা
তোমার মহত্ত্ব আর উদার চিত্তের কারণেই
এমন ভাবে ভাবো তুমি; আর পেশা খ্যাতি মর্যাদা -
এতো তোমারই প্রেরণার ফসল।
গ্রামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার
শরীরে আজও কাদামাটির গন্ধ;
জীবন ও জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে এসেছি শহরে,
কর্মচঞ্চল অথচ প্রাণহীন এই নগরীর
অলি-গলি-রাজপথে একে একে হোঁচট খেয়ে
বাস্তবতার তীব্র কষাঘাতে আমি যখন
অনেকটাই হতাশ এবং বিধ্বস্ত প্রায়
তখনই তুমি এলে কাণ্ডারী হয়ে!
হতাশার অন্ধকারে জ্বেলে দিলে প্রেরণার মশাল
বেদনা-সিক্ত হৃদয়ে দিলে মমতার শীতল পরশ
দিলে নতুন করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দীক্ষা
এক আহত যোদ্ধাকে।
শুধু তোমারই শক্তিতে ভর করে আমি
দাঁড়িয়েছি আবার মেরুদণ্ড সোজা করে,
ক্লান্তিহীন হেঁটে গেছি গন্তব্যের দিকে অবিরাম।
তোমার সান্নিধ্য আর ভালোবাসা না পেলে
হয়ত আর আমার দাঁড়ানোই হত না কোনদিন।
: না, রুদ্র, তুমি তোমার নিজের যোগ্যতা দিয়েই
দাঁড়িয়েছো, আজ তোমার যা কিছু অর্জন, যা কিছু প্রাপ্তি
তার সবটাই তোমার প্রাপ্য ছিল।
আমাদের প্রথম দেখার মূহুর্তে
তোমার বুদ্ধি দীপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি
ঠিক বুঝেছিলাম, তুমি জয় করবার ক্ষমতা রাখো অজেয়কে।
তাই নিশ্চিত নির্ভরতায় আমি তুলে দিয়েছি তোমার হাতে
আমার সমস্ত ভালো-মন্দের ভার
আমার স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা, আমার ভবিষ্যৎ।
হৃদয় নিংড়ে সবটুকু মমতা আর ভালোবাসা
শুধু তোমাকেই দিয়েছি উজাড় করে;
এখনও যা কিছু আছে, আছে যেটুকু সঞ্চয়
তার সর্বস্ব তোমাকে সঁপে দিয়ে
তোমার বুকেই সাজাব ভালোবাসার পালঙ্ক আমার।
: আমায় তুমি ধন্য করেছো নন্দিতা,
প্রথম যেদিন তোমার স্নেহসিক্ত হাত দুটো
আমার মাথায় বুলিয়েছিলে, সেই দিন সেই মূহুর্তেই
তার বিনিময়ে আমি তোমার কাছে সমর্পিত করেছি
আমার হৃৎপিণ্ড এবং নিজেকে।
এসো নন্দিতা, হাত রাখো এ হাতে
আমার চোখের তারায় তোমার দৃষ্টি কর স্থির
চলো, নদীতে ভাসাই ভেলা
নরম হাওয়ায় পাল তুলে দিয়ে, মেলে দিয়ে ডানা
চলো, চলে যাই তেপান্তরের স্বপ্নলোকের দেশে
কাশফুলে ঘর সাজাই মধুর ভালোবেসে।
প্রেমে মাখামাখি
---- অসীম তরফদার
তুমি আমার সকাল বন্ধু
দুপুর সন্ধ্যা রাতি
আমার প্রাণের প্রাণ যে তুমি
আঁধার ঘরের বাতি।
গোলাপ রাঙা অধর তোমার
মিষ্টি মধুর হাসি
সাথী হয়ে সারাজীবন
থেকো পাশাপাশি।
বন্ধু তুমি জোস্না রাতে
পূর্ণ চাঁদের হাসি
নিথর জলে ঢেউ জাগিয়ে
স্বপ্নে বাজাও বাঁশি।
মন বাগানে বন্ধু তুমি
গোলাপ হয়ে ফুটো
হৃদয় জুড়ে গন্ধ ছড়াও
স্বপ্ন মুঠোমুঠো।
বন্ধু তুমি শ্রাবণ দিনের
প্রথম কদম ফুল
মৌসুমী ঐ হাওয়ায় ওড়ে
তোমার এলো চুল।
একটুখানি দেখার আশায়
পথ চেয়ে থাকি
নানা অজুহাতে তুমি
দাও যে শুধু ফাঁকি।
আমার কথা মনে হলে
জানলা খুলে দিও
আমায় দেখার ইচ্ছে হলে
চাঁদকে দেখে নিও
নীলাকাশের চাঁদনী হয়ে
তোমার ঘরে এসে
জোসনালোকে ভরিয়ে দেবো
মধুর ভালোবেসে।
জীবন স্রোতে ছুটে যখন
ক্লান্ত হয়ে পরি
তোমার একটু সোহাগ পেতে
মাথা কুটে মরি।
সময় পেলে বন্ধু তুমি
ফুল বাগানে এসো
একটু খানি পাশে বসে
আমায় ভালোবেসো।
ক্লান্ত হলে বন্ধু তুমি
বারান্দাতে এসো
বেতের মোড়ায় চক্ষু বুজে
উদাস মনে বোসো।
দখিন হাওয়ায় মিশে তখন
আসবো আমি ছুটে
সোহাগ মাখা পরশ দেবো-
ক্লান্তি যাবে টুটে।
রোজ বিকেলে ফুল বাগানে
যদিও না আসি
হৃদয় দিয়ে বন্ধু আমি
তোমায় ভালোবাসি।
এমন করে সাধ মেটে না
ভরে না এ মন
তুমি ছাড়া শূণ্য এ ঘর
অসাড় এ জীবন।
ফাগুন মাসের পূর্ণিমাতে
ফুলের বাসর গড়ে
সাত পাকেতে বেঁধে তোমায়
নেবো আপন করে।
দুঃখ সুখে পাশাপাশি
থাকবো জীবন ভর
ভালোবেসে আমরা দুজন
বাঁধবো সুখের ঘর।
সে ঘর হবে মায়ায় ভরা
প্রেমে মাখামাখি
হিয়ার সাথে বাঁধবো হিয়া
আঁখির ফাঁদে আঁখি।
বন্ধু তুমি থাকলে পাশে
কিসের আবার দুখ
তুমি-ই বন্ধু প্রাণ ভ্রমরা
আমার স্বর্গসুখ।
তুমি আমার সকাল বন্ধু
দুপুর সন্ধ্যা রাতি
আমার প্রাণের প্রাণ যে তুমি
আঁধার ঘরের বাতি।
ভালোবাসায় ভিজব আজ
---- অসীম তরফদার
ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারিনি আজও;
দূর থেকেই দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জনা।
কাছে যেতেই গম্ভীর মুখে বলে উঠল-
“বলতে পার, সাড়ে চার বছরে কত বার
দেখা হয়েছে আমাদের ?
মাত্র তের বার আর প্রতিবারই দেরী করেছো তুমি।
কে জানে, হয়ত আমার সাথে দেখা করতেই
ভালো লাগে না তোমার,
যদি তাই হয় তবে খুশি হতে পার-
মা-বাবা পাত্র খুঁজছেন, হয়ত খুব শীঘ্রই…
কি? তুমি খুশি হয়েছো তো?”
খুশি হবো নাকি দুঃখ পাবো- ঠিক বুঝে ওঠার আগেই
বলে ফেললাম, খুশি হবো না! হাজার হোক বন্ধুর বিয়ে তো।
“শুধুই বন্ধু ! আর কিছু নয়?
আমাদের দেখা না হয় হয়েছে খুবই কম কিন্তু
টেলিফোনের কল্যাণে এতটাই বেশি কথা হয়েছে
যা একজন মানুষকে বোঝার জন্য যথেষ্ট নয় কি?
যদি তুমি কপট না হয়ে থাক
তবে আমি ঠিকই বুঝেছি তোমায়, তুমিও কি বোঝনি আমাকে?
গত বছর আমার জন্মদিনে আমাদের ঘরের ছাদে
অসাবধানে ছুটতে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগেছিল আমার
তুমি ভেবেছিলে আমি জ্ঞান হারিয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস কর
তোমাকে ঘাবড়ে দেবার জন্য আমি শুধু
জ্ঞান হারাবার ভান করেছিলাম।
আর সামান্য ঐ সময়টুকুতে তোমার চোখে মুখে
যে উৎকন্ঠা আর ব্যাকুলতা দেখেছি
‘তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না’ -
যে আকুতি শুনেছি সে কি ভালোবাসা নয়?”
আমি তর্জনী দিয়ে রঞ্জনার ঠোঁট চেপে ধরে বলি-
কেন সুধাও আবার, বুঝেছো যখন সবই!
যতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের প্রেমিক হওয়া যায়
ততটাই ভালোবেসেছি তোমাকে আমি; কিন্তু
যতটা সাহসী হলে সাগর পাড়ি দেয়া যায়
সাহসী হইনি ততটা ঠিক।
বুকের মাঝখানে, যেখানে হৃদয় থাকে সেই খানে যতটা
তীব্র করে তোমাকে বেসেছি ভালো
ততটা স্পষ্ট করে মুখ ফুটে বলতে পারিনি কখনও,
ভয় ছিল, পাছে যদি তোমার বন্ধুত্বও হারাই।
রঞ্জনা এবার নরম গলায় মিষ্টি করে বলে-
“যতবার তুমি দেরীতে এসেছো ততবারই আমি
করেছি তোমায় নিঃশর্ত ক্ষমা,
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে বিলম্ব হলে
থাকে না উপায় কোন সময়কে ফেরাবার।
এত ভালোবাসা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে
শুধু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে করতে যদি আবারও দেরী-
তোমার রঞ্জনা হয়তো চলে যেতো অন্য কারো ঘরে
একাকী তোমাকে ভেবে চোখের জলে ভেজাতো বুক;
তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া
তোমারও কি থাকত কিছু করবার?”
রঞ্জনার হাতখানি ধরে চুম্বন করি আমি,
দিগ্বিজয়ী বীরের মত আকাশে-বাতাসে কম্পন তুলে বলি-
আজ আর বিলম্ব নয় কোন
পাখিরা, তোমরা গেয়ে ওঠো সব, ফুলেরা ছড়াও সুবাস
প্র্রজাপতিরা নেচে ওঠো আমাদের চারিদিকে
আকাশ তুমি বৃষ্টি দাও, আমার রঞ্জনাকে নিয়ে
আজ আমি ভিজব ভালোবাসায়।
কোন বাঁধনে জড়ালে
---- অসীম তরফদার
: শেষ দেখা কবে হয়েছিল মনে নেই, কবে শেষ কথা;
ভালোইতো ছিলাম ভুলে
কেন এতদিন পর ডেকে আনলে হঠাৎ!
: সত্যি করে বলতো-
মনে মনে তুমি প্রত্যাশা করনি- আমি আসি?
আমি কিন্তু আশায় ছিলাম...
: কতবার আমিও ভেবেছি,
পথ চলতে গিয়ে এত জনের সাথে দেখা হয়
নন্দিতার সাথে দেখা হতে পারে না একবার?
এত মানুষের মুখ দেখি
নন্দিতার মুখখানি যদি দেখতে পেতাম!
কিন্তু যতবার ভেবেছি ততবারই পড়েছি দ্বিধায়
নিজের প্রতিচ্ছবিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের সামনে-
যদি অপছন্দ কর অথবা বিব্রত হও,
যদি ভুলে যেতে চাও আমাকে ঘিরে পুরানো অধ্যায়!
: সম্ভব হলেতো বেঁচেই যেতাম;
মাঝে মাঝে ভাবি-
ঈশ্বর যদি মিলিয়েই না দিলেন
কেন যে দিলেন না ভুলে যাবার শক্তি !
যদি আলাদাই করে দিলেন
কেন মনের ভিতর জিইয়ে রাখলেন
এত প্রেম, এত মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা!
জানি, যা কিছু হবার ছিল
অপরিণত বয়সের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে হয়নি যা কিছু-
সবই মেনে নিয়েছো সহজে; তাই
আমার কষ্টের বোঝা আরও অনেক গুন বেশি।
: হাত খানি একবার দেবে? একটু ধরে থাকি...
: সব সময় এত ফরমাল কেন, বলতো?
সেই ছেলেমানুষী মনটা আজও বেঁচে আছে;
না হয় একটু পাগলামীই করলাম!
একি! তোমার হাত কি কাঁপছে!
নাকি আমার হাত!
: সম্ভবত দুজনেরই।
এত বছর পরে দেখা,
একটু খানি স্পর্শ পেয়ে, এতটুকু উষ্ণতা পেয়ে
বহু বছরের সঞ্চিত কথাগুলো
দিশেহারা হয়ে বেরুতে চাইছে।
বিধাতার কাছে খুব বেশি কিছু চাইনি কখনও
(তোমাকে ছাড়া) সবই প্রায় পূর্ণ করেছেন তিনি।
আজ এত বছর পরেও ভালোবেসে কাছে ডেকেছ-
মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ,
সবচেয়ে সার্থক প্রেমিক!
: একবার উঠে দাঁড়াবে?
মনটা চাইছে তোমার বুকে জড়িয়ে থাকি...
: এ কী মায়ায় জড়ালে আবার নতুন করে!
ভালোইতো ছিলাম, আবার যদি হারাই...
আবার কবে দেখা হবে?
: যখন তুমি অন্তর থেকে ডাকবে!
আজ তবে চলি-
তুমি ভালো থেকো, অনেক বেশি ভালো...
হাজার বছর
---- লিমা মেহরিন
-আরে অনিন্দ্য না
এই রিকসা দাঁড়ান।
কি ব্যাপার, গেলো কোথায়!
ও কি আমাকে দ্যাখেনি
আমার দিকেই তো তাকালো
কি জানি হয়তো উদাস দৃষ্টি।
এ জনমে বুঝি দেখা হলো না আর।
চলেন ভাই।
-ঐন্দ্রিলা।
-এই যে ভাই দাঁড়ান।
অনিন্দ্য, আমি তো ভাবছি তুমি আমাকে দ্যাখোনি
রিকসাটা ছেড়ে দেই, কোথাও বসে কথা বলি।
-আচ্ছা, তোমার কি মনে নেই,
না দেখেও তোমার উপস্থিতি আমি ঠিকই বুঝতাম
আর আজ চোখের দেখা এভাবে কিভাবে ?
রিকসা ঘুরিয়ে জ্যাম ঠেলে তবেই তোমার কাছে এলাম।
মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম।
জানো বুকের মধ্যে এখনো ধুক ধুক করছে।
-কেনো ?
-যেনো হাজার বছর ধরে তোমাকে খুঁজছি
অন্ধকারের প্রতিটি কণাকে দুহাতে ঠেলে আলোর সন্ধানে ফিরছি
সেই ফেরার পথে তুমি।
ভয় হলো যদি ঝড় ওঠে
আমাকে ছিটকে ফেলে দেয় দূর সীমানায়
আবারো যদি হাঁটতে হয় বছরের পর বছর যুগের পর যুগ।
-আমাকে সত্যিই মনে রেখেছো অনিন্দ্য
আমাকে ভাবো সত্যি ?
অথচ একদিন অবহেলা করেছিলে
কতদিন পরে আজ দেখা।
-আমার অবহেলায় যেদিন অভিমানে মুখ ফেরালে,
সেদিনই বুঝেছিলাম তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন আমার।
জানো, তারপর কোনোদিন বৃষ্টি হয় নি আমার বুকে,
বসন্ত আসে নি, আমাকে জড়াতে আকাশ থেকে নামে নি পূর্ণিমার চাদর।
-এভাবে বলো না অনিন্দ্য,
দুর্বল করো না আমাকে। আমার বদলে যাওয়া পৃথিবীর
খুব গোপনে তুমি আছো।
সেখানে কেউ যেতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমিও পথ হারিয়ে ফেলি।
তোমার কাছে যেতে চায় না মন।
-আমি বিশ্বাস করি না।
তুমি মুখ লুকাতে পারো গভীর সমুদ্রের মতো দিগন্তের বুকে
স্মৃতিগুলোকে ছুঁড়ে দিতে পারো আকাশ গঙ্গার গহীন অন্ধকারে।
তবুও শিশির ভেজা চোখে স্মৃতিহীন গাঙচিল
ভরে দেবে বিষন্নতা। কান্না ভেজাবে চোখ।
স্বপ্ন উড়বে নির্জন ডানায়।
-বুকের প্রশস্ত জমিনে স্বপ্ন বোনা যায়। স্বপ্নেরা জেগে ওঠে
খেলা করে। কি অদ্ভূত ! তাই না অনিন্দ্য ?
-ঐন্দ্রিলা। কেমন আছো তুমি ?
-ওহ্ হো। রিকসা থেকে নেমেই তোমার সাথে কি সব কথা শুরু করেছি।
জানাই হলো না তুমি কেমন আছো
কোথায় থাকো এখন ?
-আমার আর থাকা। কালো মেঘ দেখেছো আকাশে ?
তার নিচেই থাকি আমি।
-হেয়ালি করো না তো অনিন্দ্য।
-ঘর বেধে কি হবে বলো ? কি প্রয়োজন তার,
বরং তোমার কথা শুনি।
কেমন আছো বললে না তো।
-তোমার অবহেলা আমাকে ভালো থাকার শক্তি যুগিয়েছে,
পৃথিবটিা সত্যিই গোল
তাই আবার দেখা হলো।
-বিদায় নেবে বুঝি !
তোমার ফেরার পথ কি রুদ্ধ করা যায় না ঐন্দ্রি ?
দ্বিখন্ডিত করো না এ পথ।
-অনিন্দ্য সত্যিই হাসালে তুমি।
যখন ভাবার কথা তখন ভাবো নি।
যে পথ দু’ভাগ হয়ে হাজার বছর হেঁটে গেছে
তাকে তুমি এক করবে কি করে ?
-আমি তবে তোমার কাছ থেকে হাজার বছর পিছিয়ে ঐন্দ্রিলা ?
যুগের পর যুগ আমি সে পথের পথিক।
-আমি অপেক্ষমান। পথিক তোমার পথ শেষ হোক।
রূপ-নারানের কুলে
---- রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর
রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ-
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন-
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।
ওটা কিছু নয়
---- নির্মলেন্দু গুণ
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও; আমি তৈরী হয়ে নিই।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তোমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার। ওটা নয়, ওটা চুল।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো, - না, না, না,
ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি, - আমার যৌবন।
সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ-প্রেমিক
ওখানে কি খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে, -এর ঠিক ডানপাশে, অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয়।
অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল, তুমিই থাকো নি।
প্রিয়তমাষু
---- সুকান্ত ভট্টাচার্য
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে
আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।
ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে:
-ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি:
কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক
রাত্রে চাঁদ ওঠে: আমার চোখে ঘুম নেই।
তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজ, লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ করে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
নির্ঝরনী
---- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন-
চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিলো মোরে ফেলি তার জাল-
তুলে নিল দ্রুত রথে
দুঃসাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখরচুড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখো চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
বসন্ত-বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রাণ্তে; বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়
সে আমার প্রেম,
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের স্নানস্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়
হে বন্ধু, বিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
পেয়েছে নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহুর্তগুলি গণ্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণি ততো করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
যদি আর বাশী না বজে
---- কাজী নজরুল ইসলাম
বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি অন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি। এই হোক, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতের বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নীরিহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নাম ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋন, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীট্সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ।” জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারনণ অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি, কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে- ঠিক সেই দিনই সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণ ভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলুম। আমার কাব্য, আমার গান, আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শূন্য হতে অসময়ে নেমে আসতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন, পূর্ণত্যের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল। যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারেই বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে, আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।
দূরে উড়ে শঙ্খচিল
---- শিহাব শাহরিয়ার
শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে যায় প্রসন্ন বিকেল
ভিজে যায় বৃক্ষের বুক, অপরাজেয় বাংলার
তিন মূর্তিমান প্রতীক, কলাভবনের শরীর
তখন করিডোরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে...
- তোমার কি কি পছন্দ?
: নীলিমার নীল, বিশুদ্ধ জ্যোৎস্না, স্মৃতির গাংচিল, দূরের শ্মশান
- ধ্যাৎ, এগুলো তো কবিতার শব্দাবলী
: তাহলে... তোমার মা এখন কেমন আছেন?
- পছন্দের কথা বলো?
: পছন্দের কথা?... কবিতা।
- জীবন তো কবিতা নয়?
: কিন্তু কবিতায় তো জীবন থাকে।
- ভিতরের কথা থাক না ভিতরে
: কিভাবে তবে বেঁচে থাকা নৈঃশব্দের নীরব মঞ্চে?
- কেন একা একা জেগে থাকো, কেন একা পথ খোঁজ নিত্য,
ভরা পূর্ণিমার রাতে?
: জানি না... এখনও কেন কার কবিতায় ভিজে হৃদয়,
কোন হরিণি নেচে যায় ছন্দে।
- দোহাই। এইবার শেষ কর কবিতার গল্প
: না, পারো কবিতায় বন্দি করে রাখো।
- তাহলে ভিতরে জন্মাবে কষ্টের পরগাছা, বরং
খুলে দাও উত্তরের জানালা। দ্যাখো-দূরের আকাশ, কাশফুল, চন্দন কাঠ।
: কাব্য নয় আর, ভালোবাসা মরে যায় নিদ্রাহীন ঘরের ভিতরে,
পেতে চায় উড্ডীণ জীবনের লবণাক্ত জল।
- তবে এই নাও সবুজ গলাপ, এই ধরো হাত,
চলো জল শুকিয়ে নদীর বুকে খুলেছে পথ।
: বসন্ত ঝরে যাক প্রাঙ্গণে, তবু তোমাতে ফিরবো না আর।
- দেখ দেখ ঐ যে ফেলে আসা নদী, ভাঙ্গা সেই ঘাট,
প্রাণের চিলেকোঠা পোহাচ্ছে রোদ্দুর।
: আমিও তো চাই ঘাস ফড়িংয়ের সোনালী পাখা, কিন্তু
সব যেন তছনছ হয়ে যায় র্দীঘ বাতাসের শ্বাসে।
- জল যেমন ভাঙ্গে ঢেউ, কিংবা জল পোকারা ভাঙ্গে জল-
তেমনি হৃদয়ের পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে কতদূর পার হয়েছ?
: বিশ্বাস করো, অলিন্দে ফোতটে না কাঁঠালচাপা আগের মতো
অন্ধকারে উঠে না নড়ে বুড়িগঙ্গা সেতু।
- আর কতগুলি মেহগনি হাওয়া, মেহেদীর রাত তোমার চাই
: কখনও চাই না রাত, কেবল তোমাকেই চাই, তোমাকে, তোমাকে।
জলের শরীরে যেমন বেঁচে থাকে মাছ কিংবা শামুক, তেমনি
তোমার শ্রাবণের জলে, আমাকে দাও একটু ঠাঁই।
- তাই বলি- যদি ফের ভালোবাস, যদি ভুল করে
আবার কখনও ফোটাতে চাও গোলাপ, বেদনার বর্ণমালা
শিখে নিও আগে, বৃক্ষের ছায়ায় নির্বাসিত করো মন।
বৃষ্টি থেমে যায়, সংলাপও... কিন্তু থামে না জীবন।
কেবল বৃষ্টি শেষে দুঃখের বৃক্ষ থেকে ঝরে যন্ত্রণার জল,
আর দূরে উড়ে শঙ্খচিল।
বারবারা বিডলার-কে
---- আসাদ চৌধুরী
বারবারা
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত-কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয় ?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।
টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো- বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিঅলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমার মুক্তিযোদ্ধার কাছে এসো-
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্যে
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়ো না-
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জং-ধরা দরজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসো ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করার পূর্বে
ছাত্রপত্রহীন সুর্যকিরণকে বিষাক্ত করার পূর্বে
এসো বারবারা, বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।
ক্ষেত মজুরের কাব্য
---- নির্মলেন্দু গুণ
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা,
আকাশে মেঘের সাথে সূর্যের
জমেছে মধুর খেলা।
ভাঙতে ভাঙতে বিজন মাঠের
কুয়াশা গিয়েছে কেটে,
কখন শুকনো মাটির তৃষ্ণা
শিশির খেয়েছে চেটে।
অতটা খেয়াল রাখেনি কৃষক
মগ্ন ছিল সে কাজে,
হটাৎপুলক পবনে হৃদয়
পুষ্পিত হলো লাজে।
ফিরিয়া দেখিল বঁধূটি তাহার
পিছনে আলের 'পরে
বসে আছে যেন, ফুটে আছে ফুল
গোপনে চুপটি করে।
সামনে মাটির লাল সানকিটি
জরির আঁচলে বাঁধা,
আজ নিশ্চয় মরিচে রসুনে
বেগুন হয়েছে রাঁধা।
হাসিয়া কৃষক মরাল বাঁশের
মুগুর ফেলিয়া দিয়া
কামুক আঁখির নিবিড় বাঁধনে
বাঁধিল বধূর হিয়া।
বরুন গাছের তরুণ ছায়ায়
দু'জনে সারিল ভোজ,
বধূর ভিতরে কৃষক তখন
পাইল মনের খোঁজ।
মেঘ দিল ছায়া, বনসঙ্গমে
পুরিল বধূর আশা-;
মনে যাই থাক, মুখে সে বলিল :
‘মরগে বর্গা চাষা।'
শব্দটি তার বক্ষে বিঁধিল
ঠিক বর্ষার মতো।
'এই জমিটুকু আমার হইলে
কার কিবা ক্ষতি হতো?'
কাতর কণ্ঠে বধূটি শুধালো :
'আইছ্যা ফুলির বাপ,
আমাগো একটু জমিন অবে না ?
জমিন চাওয়া কি পাপ?'
'খোদার জমিন ধনীর দখলে
গেছে আইনের জোরে,
আমাগো জমিন অইব যেদিন
আইনের চাকা ঘোরে।
অসহায় বধূ জানে না নিয়ম
কানুন কাহারে বলে-;
স্বামীর কথায় চোখ দু'টি তার
সূর্যের মতো জ্বলে।
'বলদে ঘোড়ায় গাড়ির চাক্কা,
নারীর চাক্কা স্বামী-;
আইনের চাকা আমারে দেখাও
সে-চাকা ঘুরামু আমি।'
কৃষক তখন রুদ্র বধূর
জড়ায় চরণ দু'টি,
পা-তো নয় যেন অন্ধের হাতে
লঙরখানার রুটি !
যতটা আঘাত সয়ে মৃত্তিকা
উর্বরা হয় ঘায়ে
ততোটা আঘাত সইল না তার
বধূর কোমল পায়ে।
পা দু'টি সরিয়ে বধূটি কহিল :
'কর কি? কর কি? ছাড়ো,
মানুষে দেখলি জমি তো দেবি না,
দুন্যাম দেবি আরও।'
পরম সোহাগে কৃষক তখন
বধূর অধর চুমি !
হাসিয়া কহিল : 'ভূমিহীন কই ?
আমার জমিন তুমি।'
আকাশে তখনও সূর্যের সাথে
মেঘেরা করিছে খেলা,
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা।
ছবি
---- আবু হেনা মোস্তাফা কামাল
আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারি স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাসে অথবা মেম্ফিস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!
আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল
নয় কি?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ
অকৃতিম;
আপনাকে আরো খুলে বলিঃ এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ
এবং যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মত করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।
খাঁটি আর্যবংশদ্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নয়টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন-কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দেখেন নি!
আর দেখুন, এই যে নরমুন্ডের ক্রমাগত ব্যবহার- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির- অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের-থিম!
অসমাপ্ত
---- নির্মলেন্দু গুণ
মননীয় সভাপতি ...। সভাপতি কে? কে সভাপতি?
ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,
আপনাকে আমি সভাপতি মানি না।
তবে কি রবীন্দ্রনাথ? সুভাষচন্দ্র বসু? হিটলার?
মাও সে তুং? না, কেউ না, আমি কাউকে মানি না,
আমি নিজে সভাপতি এই মহতী সভার।
মাউথপিস আমার হাতে এখন, আমি যা বলবো
আপনারা তাই শুনবেন।
উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আমার সংগ্রামী বোনেরা,
(একজন অবশ্য আমার প্রেমিকা এখানে আছেন)
আমি আজ আপনাদের কাছে কিছু বলতে চাই।
আপনারা জানেন, আমি কবি,
রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়ার, এলিয়েটের মতোই
আমিও কবিতা লিখি এবং মূলত কবি,
কবিতা আমার নেশা, পেশা ও প্রতিশোধ গ্রহণের
হিরন্ময় হাতিয়ার! আমি কবি, কবি এবং কবিই।
কিন্তু আমি আর কবিতা লিখবো না ।
পল্টনের ভরা সমাবেশে আমি ঘোষণা করছি,
আমি আর কবিতা লিখবো না।
তবে কি রাজনীতি করবো? কান্ট্রাক্টারী?
পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক?
পত্রিকার সাব-এডিটর?
নীলক্ষেতে কলাভবনের খাতায় হাজিরা?
বেশ্যার দালাল?
ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে তেল-নুন-ডালের দোকান?
রাজমিস্ত্রি? মোটর ড্রাইভিং? স্মাগলিং?
আন্ডারডেভেলপমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা?
নাকি সবাইকে ব্যঙ্গ করে, বিনয়ের সব চিহ্ন-সূত্র
ছিঁড়ে-খুঁড়ে প্রতিণ্ঠিত বুড়ো, বদ-কবিদের
চোখ-নাকে-মুখে কিংস্টর্কের কড়া ধোঁয়া ছুঁড়ে দেব?
- অর্থাৎ অপমান করবো বৃদ্ধদের?
আপনারা কেউ বেশ্যাপাড়ায় ভুলেও যাবেন না,
এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে বেশ্যার দালাল হতে পারি,
রসোন্মত্ত যৌবন অবধি-, একা-একা।
আমার বক্তব্য স্পট, আমার বিপক্ষে গেলেই
তথাকথিত রাজনীতিবিদ, গাড়ল বুদ্ধিজীবি,
অশিক্ষিত বিজ্ঞানী, দশতলা বাড়িওয়ালা ধনী-ব্যবসায়ী
সাহিত্য-পত্রিকার জঘন্য সম্পাদক, অতিরিক্ত জনসমাবেশ
আমি ফুঁ দিয়ে তুলোর মতন উড়িয়ে দেবো।
আপনারা আমার সঙ্গে নদী যেমন জলের সঙ্গে
সহযোগিতা করে, তেমনি সহযোগিতা করবেন,
অন্যথায় আমি আমার ঘিয়া পাঞ্জাবির গভীর পকেটে
আমার প্রেমিকা এবং ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ছাড়া
অনায়েসে পল্টনের ভরাট ময়দান তুলে নেবো।
ভাইসব, চেয়ে দেখুন, বাঙলার ভাগ্যাকাশে
আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, সুনন্দার চোখে জল,
একজন প্রেমিকার খোঁজে আবুল হাসান
কী নিঃসঙ্গ ব্যাথায় কাঁপে রাত্রে, ভাঙে সূর্য,
ইপিআরটিসি’র বাস, লেখক সংঘের জানালা,
প্রেসট্রাস্টের সিঁড়ি, রাজিয়ার বাল্যকালীন প্রেম।
আপনারা কিছুই বোঝেন না, শুধু বিকেল তিনটে এলেই
পল্টনের মাঠে জমায়েত, হাততালি, জিন্দাবাদ,
রক্ত চাই ধ্বনি দিয়ে একুশের জঘন্য সংকলন,
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিনে নেন।
আমি শেষবারের মত বলছি
আপনারা যার-যার ঘরে, পরনে ঢাকাই শাড়ি
কপালে-সিঁদুরে ফিরে যান। আমি এখন অপ্রকৃতিস্থ
পূর্ব-বাঙলার অন্যতম ভীষণ মাতাল বক্তা একজন,
ফুঁ দিয়ে নেভাবো আগুন, উন্মাদ শহর,
আপনাদের অশ্লীল-গ্রাম্য-অসভ্য সমাবেশ,
লালসালু ঘেরা স্টেজ, মাউথ অর্গান, ডিআইটি,
গোল স্টেডিয়াম, এমসিসি’র খেলা,
ফল অফ দি রোমান এ্যাম্পায়ারের নগ্ন পোষ্টার।
এখন আমার হাতে কার্যরত নীল মাইক্রোফোন
উত্তেজিত এবং উন্মাদ।
শ্রদ্ধেয় সমাবেশ, আমি আমার সাংকেতিক
ভয়াবহ সান্ধ্য আইনের সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
মাধবীর সারা মাঠ খালি করে দেবেন।
আমি বড় ইনসিকিওরড, যুবতী মাধবী নিয়ে
ফাঁকা পথে ফিরে যেতে চাই ঘরে,
ব্যক্তিগত গ্রামে, কাশবনে।
আমি আপনাদের নির্বাচিত নেতা।
আমার সঙ্গে অনেক টাকা, জিন্নাহর কোটি কোটি
মাথা; আমি গণভোটে নির্বাচিত বিনয় বিশ্বাস,
রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, অথচ আমার কোনো
সিকিউরিটি নেই, একজন বডিগার্ড নেই,
সশস্ত্র হামলায় যদি টাকা কেড়ে নেয় কেউ
-আমি কী করে হিসেব দেবো জনতাকে?
স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি হলে কন্যার কাঁকন যাবে খোয়া,
আপনার আমার সকলের ক্ষতি হবে,
সোনার হাতে সোনার কাঁকন আর উঠবে না।
আপনারা ভাবেন, আমি খুব সুখে আছি,
কিন্তু বিশ্বেস করুন, হে পল্টন,
মাঘী পূর্ণিমার রাত থেকে ফাল্গুনের পয়লা অবধি
কী ভীষণ দুর্বিষহ আগুন জ্বলছে আমার দুখের দাড়িতে,
উষ্কখুষ্ক চুলে, মেরুদণ্ডের হাড়ে, নয়টি আঙুলে,
কোমরে, তালুতে, পাজামার গিঁটে, চোখের সকেটে।
দেখেছি তো কাম্যবস্তু স্বাধীনতা, প্রেমিকা ও গ্ণভোট
হাতে পেয়ে গেল নির্জন হীরার আগুনে
পুলিশের জীপ আর টায়ারের মতো পুড়ে-পুড়ে যাই,
অমর্যাদা করি তাকে যাকে চেয়ে ভেঙেছি প্রসাদ,
নদী, রাজমিস্ত্রী এবং গোলাপ।
আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীন হতে ভালোবাসি।
প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে মনে হয় বিরহের
স্মৃতিচারণের মতো সুখ কিছুই নেই।
বাক-স্বাধীনতা পেলে আমি শুধু প্রেম, রমণী, যৌনতা
ও জীবনের অশ্লীলতার কথা বলি।
আমি কিছুতেই বুঝিনা, আপনারা তবু কোন বিশ্বাসে
বাঙলার মানুষের ভবিষ্যৎ আমার স্কন্ধে চাপিয়ে দিলেন।
আপনারা কী চান?
ডাল-ভাত-নুন?
ঘর-জমি-বউ?
রূপ-রস-ফুল?
স্বাধীনতা?
রেফ্রিজারেটর?
ব্যাংক-বীমা-জুয়া?
স্বায়ত্তশাসন?
সমাজতন্ত্র?
আমি কিছুই পারি না দিতে,আমি শুধু কবিতার
অনেক স্তবক, অবাসস্ত অন্ন বস্ত্র বীমাহীন জীবনের
ফুল এনে দিতে পারি সকলের হাতে।
আমি স্বাভাবিক সুস্থ সৌভাগ্যের মুখে থুথু দিয়ে
অস্বভাবিক অসুস্থ শ্রীমতী জীবন বুকে নিয়ে
কী করে কাটাতে হয় অরণ্যের ঝরের রাত্রিকে
তার শিক্ষা দিতে পারি। আমি রিজার্ভ ব্যাংকের
সবগুলো টাকা আপনাদের দিয়ে দিতে পারি,
কিন্তু আপনারাই বলুন অর্থ কি বিনিময়ের মাধ্যম?
জীবন কিংবা মৃত্যুর? প্রেম কিংবা যৌবনের?
অসম্ভব, অর্থ শুধু অনর্থের বিনিময় দিতে পারে।
স্মরণকালের বৃহত্তম সভায় আজ আমি
সদর্পে ঘোষণা করছি, হে বোকা জমায়েত,
পল্টনের মাঠে আর কোনোদিন সভাই হবে না,
আজকেই শেষ সভা, শেষ সমাবেশে শেষ বক্তা আমি।
এখনো বিনয় করে বলছি, সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
আপনারা এই মাঠ খালি করে দেবেন।
এই পল্টনের মাঠে আমার প্রেমিকা ছাড়া
আর যেন কাউকে দেখি না কোনোদিন।
এই সারা মাঠে আমি একা, একজন আমার প্রেমিকা।
যা চেয়েছি, যা পাবো না
---- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কী চাও আমার কাছে ?
কিছু তো চাইনি আমি !
চাওনি তা ঠিক।
তবে কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
জানি না। ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো দূরবর্তী নৌকো
চতুর্দিকে তোমাকেই দেখা।
সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
মনে হয় তুমি দেবী-
আমি দেবী নই।
তুমি তো জানো না তুমি কে !
কে আমি !
তুমি সরস্বতী
শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নীরা নামে ডাকি।
হাসি পায় শুনে
যখন যা মনে আসে
তাই বলো ঠিক নয় ?
অনেকটা ঠিক। যখন যা মনে আসে-কেন মনে আসে ?
কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
আশীর্বাদ !
আশীর্বাদ ! আমার, না সত্যি যিনি দেবী।
তুমিই তো সেই। টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি, উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও।
যথেষ্ট পাগল আছো। আরও হতে চাও বুঝি ?
তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন শান্তশিষ্ট
না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
যে জীবন মানুষের ?
আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
তোমার ভিতরে তুমি,
শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা ?
শোন্ খুকী
এই মাত্র দেবী বললে...
একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
কী আছে আমার ? জানি না তো
তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব, শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ?
আমি ধনী হবো
আমার তো দুঃখ নেই !
দুঃখের চেয়েও কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর কী দেবো তোমাকে ?
তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু'হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
কিছু নয় !
অভিমান ?
নাম দাও অভিমান !
এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
মৃত্যু ?
ছিঃ , বলতে নেই
তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
পাওনি কি ?
বুঝতে পারি না ঠিক। বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
ফের পাগলামি ?
দেখা দাও।
আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
না !
কেন ?
বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর ঐ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তবু এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে...
তুমি কবি ?
তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
কী চাও আমার কাছে ?
কিছু নয়। আমার দু'চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?
তৃষিত তিমির
---- আসমা বেগম শীলা
: হ্যালো
- হ্যাঁ বলছি
: এখনো জেগে আছো?
- সন্দেহ আছে? ভূতের গলার সঙ্গে মিলিয়ে ফেল নাকি?
: রেগে যাচ্ছ কেন? বলেছিইতো ক্লাস শেষ হলে রিং করব।
তাছাড়া সেদিন বললে না তোমার রাতের পড়া নষ্ট করি।
- করই তো
: কি বই পড়ছিলে?
- হুম, হিউম্যান সাইকোলজি
: এও পড়তে হয় নাকি
- পরীক্ষা পাশের জন্য নয় মনুষ্য হৃদয় জানিবার জন্য হে-
: কতটা পারলে? ডিস্টার্ব করছি না তো ?
- ওহু, সাহায্য করছ
: কেমন?
- তুমি গিনিপিগ। হিউম্যান সাইকোলজির প্র্যাকটিক্যাল এলিমেন্ট
: কি হলো? কথা বলছ না যে?
- তোমার সংস্কৃতি চর্চার কতদূর এগুলো?
: মাইল খানেক
- সে যাক পলির খবর কি?
: ভালো। তোমার কথা প্রায়ই বলে, কথা বলতে চায়।
- তাই নাকি?
“নিজের সাথে যুদ্ধ করি
তোমার সাথে মিত্রতা
নিজ হৃদয়ে মিথ্যে প্রবোধ
মানুষ বলে হিংস্রতা”
পলিকে বলো সাত দিনের প্রজেক্টে সব আধুনিক কবিতা
মুখস্ত করে ফেলব-
নিশ্চয়ই বাতিক আছে।
: বিয়ে করছ তাহলে ব্রহ্মচারী?
- নয়তো কি? তুমিই তো বলো বয়স্ক পুরুষ বড় নিঃসঙ্গ,
স্বস্তির জন্য, নিঃশ্বাসের জন্য ক্লান্তিতে হেলান দেয়ার
জন্য একজন সুবোধ সঙ্গী চাই। তা ছাড়া পলি! –যাকে
বলে সাক্ষাত অন্নপূর্ণা। রন্ধনে সিদ্ধহস্ত বিদ্যায় গরিয়সী,
সামাজিকতায় সমকালীন, ভূষণে আধুনিক আর
চিত্তহরণে আজরা জ্যাবিন।
: মানে?
- মানে যাদুকরী, আমার চিত্ত লুপ্তপ্রায়।
: ইয়ার্কী কর না। ওর মায়ের সাথে কথা বলব?
- তার আগে বলো আমাদের বিয়েতে কি দিচ্ছ?
: কেন?
- সেটা নিজে কিনে নিতে চাই
: মানে?
- মানে ৫৮০/= টাকা টেলিফোন বিল শোধ দিতে চাই
আমাকে রিং করে তোমার যে অর্থ দন্ডি হয়েছে।
: শোধ কেন?
- ঋণীই বা থাকবো কেন?
: প্রয়োজন তো আমার ছিল
- কিসের প্রয়োজোন?
এই একটু হৃদয় নাড়ানোর, স্বপ্নের উদ্যানে বীজ ছড়ানোর
কুয়াশার ক্যানভাসে কুয়াশা আঁকার কি এমন তুমুল
প্রয়োজন ছিল?
: তুমিই কি কখনো ভেবেছ আমার তৃষ্ণার্ত সূর্যের এক
একটি মৃত্যুর কথা
কখনো জানতে চেয়েছ কোন অহংকারে
কোন স্বপ্ন বুকে নিয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকি আমি।
- আমি যদি একই প্রশ্ন তুলি?
: তুমিতো ব্রহ্মচারী, অনাসক্ত হৃদয় তোমার
এতো প্রাণ কোথা পাবো তোমাকে ভাসাই?
- অন্ধকারে অন্ধকার ঘষে কখনো কোথাও আলো জ্বলে।
তমা তুমি শুধু জ্বলাতে পার, পার না?