আমার হাসপাতাল ভ্রমণ

সেদিন ছিল সোমবার। আকাশ মেঘলা। বিকেলটাকেই সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। বুকের বাঁ পাশে আগের রাত থেকেই ব্যথা। গ্যাসট্রিকের ওষুধ হাফ পাতা খেয়ে ফেলেছি, ব্যথার কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিলাম, ও বলল, ‘সলিড কোনো জিনিস তোর পেটে সইবে না রে, গ্যাসট্রিকের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল খেয়ে লাভ নেই, লিকুইড কিছু খা।’
—কী লিকুইড?
—লিকুইড অ্যান্টাসিড।
সেটা খাওয়ার পর অবস্থার দারুণ উন্নতি হলো। বুকের বাঁ পাশের ব্যথা সামান্য বাড়ল, সঙ্গে বা হাতে ব্যথা শুরু হলো। একি বামপন্থী যন্ত্রণায় পড়া গেল। ভয় পেয়ে গেলাম, গলার বাঁ সাইডে যাতে ব্যথা শুরু না হয়, রাতে শো আছে। রাত ১১টা থেকে দুইটা টানা বকবক করতে হবে। এর মধ্যে কেমন যেন এক ঠান্ডা বাতাস ছাড়ল, আকাশ আরেকটু অন্ধকার হলো। বন্ধু বাদ দিয়ে এবার এক ডাক্তার বড় ভাইকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, ‘তোমার বাসার কাছেই হার্ট ফাউন্ডেশন, একটা ইসিজি করে ফেলো এক্ষুনি, দেরি কইরো না।’
বউকে বললাম এক কাপ চা দাও। চা ভালো হলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। অনেক দিন মেঘলা দিনে রিকশায় ঘুরি না। মিতু মহা আনন্দিত হয়ে চা বানাল। আনন্দের মাত্রা বেশি হওয়ায় চা হয়ে গেছে পৃথিবীর অখাদ্যতম চা। তবু চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হলো, বাহ, লাইফ ইজ বিউটিফুল।
চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে রিকশায় চড়ে বসলাম। পাশে মিতু। ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা মনে পড়ে গেল। আহা, কত মধুর ছিল সেই দিনগুলো। মিতুর সঙ্গে কত বছর পর রিকশায় উঠলাম।
রিকশায় উঠে মিতু জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
বললাম, ‘হাসপাতালে। কাছেই হার্ট ফাউন্ডেশন। সামান্য কাজ আছে, ওটা শেষ করে একসঙ্গে আইসক্রিম খাব। আজ আমাদের ডেটিং।’
হার্ট ফাউন্ডেশনের ইমার্জেন্সিতে ইসিজি হলো। ইসিজি রিপোর্ট দেখে ডাক্তার শুধালেন, ‘আপনার সঙ্গে কে আছে?’
অত্যন্ত দার্শনিক প্রশ্ন। আমার চোখে জল এল। হে ডাক্তার, মানুষ মূলত একা।
এরপর ডাক্তার, নার্স, মিতু ছোটাছুটি শুরু করে দিল। বুঝলাম অবস্থা বেশি সুবিধার না বোধ হয়। সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছে মিতু, বেড়াতে এসে একি বিপদে পড়া গেল। শুনলাম, আমাকে ভর্তি করা হচ্ছে। ডাক্তারকে ডেকে বললাম, ভাই, আমার অবস্থা কী?
ডাক্তার শুকনো কিশমিশের মতো হাসি দিয়ে বললেন, ‘অবস্থা ভালো, চিন্তা কইরেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকেন।’
এক সিস্টার খুব হাসিমুখে এলেন। তাঁর হাতের মুঠোয় কী যেন। প্রথমে ভাবলাম, হয়তো বকুল ফুলটুল হবে, হাজার হলেও আমি সেলিব্রেটি মানুষ। টিভিতে দেখায়, রেডিওতে গলা শোনা যায়। ও হরি, তাঁর মুঠো ভর্তি ট্যাবলেট। আমার ধারণা, তাঁর স্টকে যত ধরনের ট্যাবলেট আছে, সব তিনি নিয়ে এসেছেন। ট্যাবলেট দিয়েই দারুণ একটা ডিনার হয়ে গেল।
এর মধ্যে অন্যান্য আয়োজন চলছে। ছোট ডেস্কটপ মনিটর, অক্সিজেন এবং আরও নানা আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, কোলাহলমুক্ত, কম্পিউটারাইজড একটা ওয়ার্ডে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়ে আরও কয়েকজন ডাক্তার দেখলেন। তাঁদের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তাঁদের পরামর্শে অনতিবিলম্বে একটা বস্তু নিয়ে আসা হলো। দেখতে অনেকটা মর্টারশেলের মতো, তার ভেতরে যথারীতি সবুজ রঙের ‘লিকুইড’। সেই বিকটদর্শন ক্ষেপণাস্ত্র আমার শরীরে ফিট করে দেওয়া হলো, সেখান থেকে তরল ঢুকছে আমার শরীরে। একি হ্যাপা। (পরে শুনেছি, এই তরলের নামও হ্যাপারিন।)
এই যন্ত্রণা সারা রাত চলল। মাঝে চোখ খুলে দেখি, পাশে পাথরমুখে মিতু বসে আছে। ভাবলাম মিতুকে বলি, একটু হাসিমুখে বসে থাকো। আজরাইল এলে যেন অ্যাট লিস্ট তোমাকে দেখে ইমপ্রেস হয়ে আমাকে এ যাত্রা রেয়াত করে।
ভোরে আরও একদল ডাক্তার এলেন। রিপোর্ট দেখে তাঁদের মুখ আরও কালো হয়ে গেল। তাঁরা আমার নাভির চারদিকে ইনজেকশন দিতে বললেন। নাভিতে ইনজেকশন দেওয়া শুরু হলো। রাত থেকে আমি প্রায় ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, আমাকে কি কালকে কুকুর কামড়েছিল?
তৃতীয় দিন অবস্থার খানিকটা উন্নতি হওয়ায় কেবিনে ট্রান্সফার করা হলো। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী, সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এল। তাদের সঙ্গে কথা বলে বিমলানন্দ পেলাম।
তাদের প্রশ্ন একটাই: ‘কী হইছিল? ব্যাপারটা বলো তো দেখি? ঘটনাটা ঘটল কেমনে?’
আমি সবিনয়ে জানালাম, পুরো ব্যাপারটি লিখিত আকারে আপনাদের জানাব।
তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও কয়েকটা চমকপ্রদ বিষয় জানা গেল। যথা:
আমার যে এই রকম দশা হবে, এটা সবাই আগে থেকেই জানতেন।
আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, ঠিক একই রকম সিচুয়েশনে পড়েছিল তাদের কোনো না কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার তাঁরা প্রত্যেকেই মারা গেছেন। সেসব মানুষ কীভাবে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় তিলে তিলে, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছেন, সেই মৃত্যু বর্ণনা, তাঁরা গভীর আনন্দ নিয়ে বর্ণনা করলেন।
তাঁদের প্রত্যেকের একজন পরিচিত ডাক্তার আছেন, তাঁদের মতে, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। আমার উচিত, এখনই সেই ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া।
আমাকে টেনশন করা বাদ দিতে হবে, কেননা হার্টের রোগীর এক সেকেন্ডেরও গ্যারান্টি নেই। কাজেই যেকোনো সময় আমার ভালোমন্দ একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। আমি যেন টেনশন না করি।
আমি মরে গেলে আমার বউ বিধবা হবে, বাচ্চারা এতিম হবে এবং আমার কোনো গ্যারান্টি নেই। কাজেই আমাকে হাসিখুশি থাকতে হবে।

দুই.
আমাকে আরেকবার ইসিজি করা হলো। এবারও রিপোর্টে ঝামেলা আছে। ডাক্তাররা এনজিওগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অপারেশনের আগে আরও কিছু রুটিন টেস্ট করতে হবে। ইউরিন স্যাম্পল নিতে একজন এলেন। আমি তাঁর হাতে ইউরিনের টেস্টটিউব তুলে দিতে যাব, এমন সময় সে বিকট চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ভাই, আপনে ইয়াং নাইট করেন না, আপনে রে তো টিভিতে দেখি।’
আমি তাঁর হাতে ইউরিনভর্তি টেস্টটিউব তুলে দিলাম। মূত্রভর্তি সেই টেস্টটিউব তিনি এমন তমিজের সঙ্গে নিলেন, তাঁর হাতে অস্কার তুলে দিলেও খুব সম্ভবত এতটা আপ্লুত তিনি হতেন না।

তিন.
এনজিওগ্রামের আগে ছোট একটি সভা হলো। যদি রিং বসাতে হয়, তা হলে কী করা হবে। রিংয়ের দাম শুনে আমার হার্ট খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হওয়ার দশা, বলে কী। আমি হতদরিদ্র মানুষ, এত টাকা হুট করে আমি কোথায় পাব?
মুসা ইব্রাহীম তাঁর পকেটে চাপড় মেরে বলল, ‘চিন্তা করিস না, আমার পকেটে তিন লাখ টাকা আছে। তুই টেনশন করিস না।’
মিতুও তার ছোট্ট পার্স নেড়ে ঘোষণা করল, ‘আমার পার্সে তিন লাখ টাকা আছে। তুমি একদম চিন্তা করবা না।’
আমি চোখের পানি লুকালাম। বললাম, ব্যাংক এক লাখ টাকার নোট ছাড়ছে নাকি।

চার.
ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ছুরি, কাঁচি, কাঁটা চামচ দিয়ে পুরো চায়নিজ রেস্টুরেন্টের পরিবেশ। মনে হচ্ছে, একটু পরে খাবার আসবে।
এনজিওগ্রাম শুরু হলো। পায়ের রগ কেটে সেখানে পাইপ ঢুকানো হয়েছে। সেটি ঠেলে ঠেলে হার্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শৈশবের পড়া সব সূরা আমি একনাগাড়ে পড়ে যাচ্ছি। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী অবস্থা? ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না।
আমি আবার জানতে চাইলাম, তিনি এবারও চুপ।
তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করার আগে তিনি জানালেন, ‘কী অবস্থা হলে আপনি খুশি হন?’
বললাম, কোনো ব্লক যাতে না থাকে।
ডাক্তার হাসিমুখে জানালেন, ‘হার্টে কোনো ব্লক নেই।’
আমি সেই শোয়া অবস্থায় আবেগের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গেছি। বিকট একটা চিৎকার দিয়ে বললাম, থ্যাংক ইউ ডাক্তার, প্লিজ, আসেন হাত মেলাই।
ডাক্তার সাহেব তাঁর রক্তমাখা গ্লাভস পরা হাত দেখিয়ে বললেন, ‘এখন তো হাত মেলানো সম্ভব না। হাত ধুয়ে আসি।’ আমি তবু তার বাহু জড়িয়ে ধরলাম।
এরপর তিনি বললেন, ‘হাসপাতালে আপনার জন্য এত লোক কেন? নানা হাসপাতালের ডাক্তার, আর্মি অফিসার, মিডিয়ার লোকজন, এভারেস্ট বিজয়ী—এরা কারা?’
বললাম, এরা আমার ভাই ব্রাদার।
ঠিক তখনই আরেকজন যিনি ডাক্তারকে সহযোগিতা করছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, ‘ভাই, আপনার গলা চেনা চেনা লাগে? আপনি রবী না সিমু?’
আমি পুরো অসহায় অবস্থায় ওটির বেডে শুয়ে আছি। গায়ে এক গাছি সুতাও নেই। এ অবস্থায় কি আসল পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে?
আমি বললাম, আমার নাম সিমু নাসের। বাড়ি কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।

পাঁচ.
অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমার হার্টে এনজিওগ্রাম করে কী পাওয়া গেছে। আমি হার্টের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটি দেখেছি। একটা নারীর মুখ খুব স্পষ্টভাবে দেখা গেল। তাকে অলরেডি জানিয়েছি ব্যাপারটা। সে পাত্তাই দিল না। হায়, এক হূদয়হীনার কাছে হূদয়ের দাম কী আছে?